২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার,রাত ১১:০৬

রাজশাহীতে তাহের হত্যা মামলার ২ আসামির ফাঁসি কার্যকর

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৩

  • শেয়ার করুন

রাবি সংবাদদাতা: দেশের বহুল আলোচিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই আসামিকে একই মঞ্চে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে রায় কার্যকর করা হয়।মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুই আসামি হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং ড. তাহেরের বাড়ির কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম।সিনিয়র জেল সুপার আবদুল জলিল বলেন, ‘হত্যা মামলার দুই আসামি অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের পর মরদেহ ময়নাতদন্ত করা হবে। পরে কারাবিধি মেনে মরদেহ দুই পরিবারের কাছে হস্তান্তর হবে।


ফাঁসির রায় কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ, রাজশাহী জেলার সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুক, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র যে সুপার আব্দুল জলিল, জেলার নিজামুদ্দিন। এছাড়াও কারা কর্তৃপক্ষ আট জনের দুটি মেডিকেল টিম তৈরি করেছিল। যার একটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডা. মিজান উদ্দিন, আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন ডা. জোবায়ের আহমেদ। এর আগে, রাত নয়টার দিকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছন ফটক দিয়ে প্রশাসনের চারটি গাড়ি প্রবেশ করে।রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জানা গেছে, একই মঞ্চে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। কয়েকদিন আগে প্রস্তুত করা হয়েছিল ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি কার্যকর করতে আট জন জল্লাদের একটি টিম গঠন করে কারা কর্তৃপক্ষ। বুধবার (২৬ জুলাই) কয়েক দফায় শেষ করা হয়েছে ফাঁসির চূড়ান্ত মহড়াও। ফাঁসি কার্যকর করতে প্রধান জল্লাদ আলমগীরসহ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে নজরুল, সুমন, উজ্জল, মজনু, নাসির, আশরাফুল এবং রিয়াজুল নামের অপর সাত জল্লাদকে। এর মধ্যে প্রধান জল্লাদ আলমগীরের বেশ কয়েকটি ফাঁসি দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একেবারে নতুনভাবে জল্লাদের খাতায় নাম লিখেছেন দেশের আরেক আলোচিত রাজশাহীর পুঠিয়ার মহিমা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি উজ্জল। আরেক নতুন জল্লাদ হলেন রিয়াজুল। এছাড়া বাকি পাঁচ জল্লাদের আগের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই জল্লাদেরা সবাই কোন না কোন হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি।
জানা যায়, সিনিয়র জেল সুপারের সাদা রুমাল ফেলে সংকেত দেওয়া মাত্রই হ্যান্ডেল টেনে ফাঁসি কার্যকর করেন প্রধান জল্লাদ। তার সঙ্গে একজন সহযোগী ছিলেন। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজন দুই আসামিকে ধরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। আর দু’জন তাদের কালো কাপড়ের টুপি ও গলায় দঁড়ি পরিয়ে দেন।
আলোচিত মামলায় দুই আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করে কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের দক্ষিণ দিকের দেওয়াল ঘেঁষে এবং ১৪ নম্বর সেল ও যমুনা ওয়ার্ডের (পাগলা ওয়ার্ড নামে পরিচিত) পাশেই এই ফাঁসির মঞ্চ। এছাড়াও যে দঁড়িতে ঝোলানো হবে তাতে আসামিদের তিনগুণ ওজনের বস্তা বেঁধে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ফাঁসির দঁড়িটিও প্রস্তুত করা হয়েছে। কারাগারের নির্ধারিত এই ফাঁসির মঞ্চ এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রস্তুত করা হয়।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি দুই আসামিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান, সিনিয়র জেল সুপার আবদুল জলিল। তিনি এ সময় মামলার শুরু থেকে শেষ রায় পর্যন্ত পড়ে শোনান। এরপর তাদের গোসল করিয়ে খাবারের বিষয়ে শেষ ইচ্ছা আছে কি না জানতে চাওয়া হয়। পরে ফাঁসি কার্যকরের আগে দুই আসামিকে তওবা পড়ান কারা মসজিদের ইমাম মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম। এর পর ১০টার আগেই তাদের ফাঁসির মঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

পরে একই মঞ্চে একসঙ্গে একই সময় দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়। এরপরে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে পাঠানোও হয়। জাহাঙ্গীরের লাশ পাঠানো হয় নগরীর মতিহার থানার খোঁজাপুরে। আর মহিউদ্দিনের লাশ পাঠানো হয় ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার গ্রামের বাড়িতে।
গত ২৫ জুলাই দুই আসামির পরিবারের সদস্যরা তাদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেছেন। জাহাঙ্গীরের পরিবারের ৩৫ সদস্য তার সঙ্গে দেখা করেন। আর মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে তার পরিবারের পাঁচ সদস্য। এরপর তাদের পরিবারের আর কেউ দেখা করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি বাড়ির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় ড. এস তাহেরের মরদেহ। এরপর রাবি অধ্যাপক তাহেরের করা একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) সূত্র ধরে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও রাবি ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তার বাড়ির কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরসহ আটজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারদের মধ্যে তিনজন আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক ড. এস তাহের বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মো. মহিউদ্দিন এই হত্যার পরিকল্পনা করেন। বালিশ চাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ বাড়ির পেছনে নেওয়া হয়। মরদেহ গুমের জন্য জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ড. তাহেরের মরদেহ ফেলা হয়।
২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাবির কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক ড. এস তাহেরের মরদেহ। এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভী আহমেদ রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দু’জনকে খালাস দেন। দণ্ডিতরা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. এস তাহেরের বাড়ির সেই কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালাম।
খালাসপ্রাপ্ত চার্জশিটভুক্ত দুই আসামি হলেন- রাবি ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী। ২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির (নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সম্বন্ধী আব্দুস সালাম) দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন হাইকোর্ট।
এরপর আবারও রিভিউ আবেদন করেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান দুই আসামি। গত এই বছরের ২ মার্চ এ হত্যা মামলায় দুজনের ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।
নিম্ন আদালতে দুজনের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় এসেছিল তাই বহাল থাকে আপিল বিভাগেও। আর খারিজ হয়ে যায় রিভিউ আবেদনও। এজন্য প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না তাদের কাছে। এরপরও অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দণ্ডিত এ দু’জনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু উত্থাপিত হয়নি মর্মে পরবর্তী সময়ে সেই আবেদনও খারিজ করে দেন বিচারপতি মো. জাফর আহমেদ ও মো. বশির উল্ল্যার হাইকোর্ট বেঞ্চ। মূলত এরপরই কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে এ ঘটনায় দোষ স্বীকার করে নিজেদের প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। তবে রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। গত ৫ জুলাই সেই চিঠি রাজশাহী কারাগারে পৌঁছায়। এর পর থেকে তাদের ফাঁসি কার্যকর করার প্রস্তুতি শুরু হয়।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন