প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২১
পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা আজ। হিজরী সালের সফর মাসের শেষ বুধবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্মারক দিবস হিসেবে পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা পালিত হয়।
এ উপলক্ষে আজ বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মঙ্গলবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে আখেরি চাহার শোম্বা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইবনে ইসহাক তার সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থে বলেছেন, সফর মাসের শেষ কী রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে মোহাম্মদ (সা.)-এর আল্লাহর সম্মানজনক সান্নিধ্যে অন্তিমযাত্রার অসুখ শুরু হয়। ওই সময়ে এক মধ্যরাতে তিনি গিয়েছিলেন বাকিউল গারকাদের কবরস্থানে। সেখানে মৃত ব্যক্তিদের জন্য তিনি মোনজাত করেন। ভোরে ঘরে ফিরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
মোহাম্মদ (সা.)-এর ওই অসুখ যে তার মৃত্যুযাত্রার সূচনা, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। মোহাম্মদ (সা.) ও তার মুক্ত ক্রীতদাস আবু সওয়ায় হিবার কথোপকথন থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। মোহাম্মদ (সা.) যখন মধ্যরাতে বাকিউল গারকাদের কবরস্থানে যান, তখন হিবাও সেখানে গিয়েছিলেন। হিবা বলেন, মোহাম্মদ (সা.) আমাকে দেখে বললেন, ‘আমাকে দুটো বিকল্পের একটি পছন্দ করতে বলা হয়েছে—এই জগতের সব সম্পদের মালখানার চাবি ও দীর্ঘজীবন অথবা বেহেশত, আমার আল্লাহর দিদার এবং তাৎক্ষণিক বেহেশত।’ হিবা বলেন, ‘আমি বললাম, আপনি প্রথমটি পছন্দ করেন।’ তিনি বললেন, ‘আমি দ্বিতীয়টি পছন্দ করেছি।’ অর্থাৎ মোহাম্মদ (সা.) মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভকে বেছে নিয়েছেন। আর এরই পরিপেক্ষিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ওই অসুখে তার জীবনাবসান হবে, তা তার অজানা ছিল না।
মোহাম্মদ (সা.)-এর কী অসুখ হয়েছিল, তা নিয়ে দুটি বিবরণ পাওয়া যায়। ইবনে ইসহাক তার সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থে দাবি করেন, মোহাম্মদ (সা.) বাকিউল গারকাদের কবরস্থান থেকে ফিরে প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হন। অন্যদিকে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ইবনে হিশাম তার সিরাতুন নবী (সা.) গ্রন্থে বলেন, মোহাম্মদ (সা.) তার অন্তিম যাত্রায় প্রচণ্ড মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। মূলত মোহাম্মদ (সা.) প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে অসহ্য মাথাব্যথা অনুভব করেন। ওই মাথাব্যথা এতটা মারাত্মক ছিল, তিনি তার অন্তিমযাত্রার অধিকাংশ সময় অজ্ঞান ছিলেন। একটু সুস্থ হলেও আবার জ্ঞান হারাতেন।
আবিসিনিয়া থেকে আনা ওষুধ খাওয়ানো হলেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিছুক্ষণ ভালো থাকলেও পরমুহূর্তে তিনি জ্ঞান হারাতেন। এ অবস্থায় মোহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের সদস্য ও সাহাবীরা তার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। ওই নিরাশার মধ্যেই একদিন মোহাম্মদ (সা.) আশার আলো জ্বালালেন। তিনি এক সকালে জ্ঞান ফিরে পেলেন। অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। সাত কুয়োর জল দিয়ে গোসল করেন। নবী কন্যা ফাতেমা (রা.) এবং দুই নাতি হাসান (রা.) ও হোসেনকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খান। মোহাম্মদ (সা.)-এর ওই সুস্থ হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্য ও সাহাবীরা আনন্দে আত্মহারা হন। খুশিতে তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নফল নামাজ আদায় করেন। আল্লাহর নামে গরিব-দুঃখীর মাঝে সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করেন। হজরত আবু বকর (রা.) পাঁচ হাজার, হজরত উমর (রা.) সাত হাজার, হজরত আলী (রা.) তিন হাজার দিরহাম এবং হজরত আবদুর রহমান বিন আউফ একশত উট দান করেন।
নবিপত্নী হজরত আয়েশা (রা.)-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সফর মাসের শেষ বুধবার মোহাম্মদ (সা.) হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠেন। যদিও দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে মুহাম্মদ (সা.) আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওই ঘটনাকে আজও মুসলিমরা প্রতিবছর স্মরণ করেন। সফর মাসের শেষ বুধবার ওই ঘটনা ঘটে বলে এর নামকরণ হয় আখেরি চাহার শোম্বা।
আখেরি চাহার শোম্বা মূলত ফার্সি পরিভাষা। ফার্সি শব্দ আখেরি অর্থ শেষ। চাহার অর্থ সফর মাস এবং শোম্বা অর্থ বুধবার। অর্থাৎ সফর মাসের শেষ বুধবারে মোহাম্মদ (সা.)-এর সাময়িক সুস্থতাকে স্মরণ করে মুসলমানরা যে ইবাদত করেন, তাই আখেরি চাহার শোম্বা। পৃথিবীর সব মুসলিম যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে এই দিনটি স্মরণ না করলেও বাংলাদেশসহ ভারত উপমহাদেশের মুসলিমরা এই দিন বিশেষভাবে পালন করেন। পারসিক প্রভাবিত এই এলাকার ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় আখেরি চাহার শোম্বা। কারণ, এ অঞ্চলের সুফিরা এবং দিল্লির শাসকরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দিনটি পালন করতেন। ফলে ধীরে ধীরে দিনটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করা এই এলাকার মুসলিমদের ধর্মীয় জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।
ফারসিতে এ দিনটিকে আখেরি চাহার শোম্বা নামে অভিহিত করা হয়। ফারসি শব্দমালা আখেরি চাহার শোম্বা অর্থ শেষ চতুর্থ বুধবার। রাসুলুল্লাহ (সা.) জীবনে শেষবারের মতো রোগমুক্তি লাভ করেন বলে দিনটিকে মুসলমানেরা প্রতিবছর ‘শুকরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করেন। নফল এবাদত বন্দেগির মাধ্যমে দিবসটি অতিবাহিত করেন তারা।