প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২১
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালানোর এক ঘটনা ফাঁস হয়েছে।
ইসরায়েলে তৈরি হ্যাকিং সফটঅয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো এই নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৬টি সংবাদপত্র এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা ফাঁস করেছে।
এই হ্যাকিংয়ের লক্ষ্যবস্তের তালিকায় ভারতের অন্তত ৩০০ রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিজ্ঞানীর নাম থাকার কথা জানিয়েছে দেশটির নিউজ পোর্টাল দ্য অয়্যার।
তবে ভারত সরকার এই আড়িপাতায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ফাঁস হওয়া একটি ডেটাবেইসে এই ফোন নম্বরগুলো প্রথমে পায় প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, পরে তারা গার্ডিয়ান, দ্য অয়্যারসহ ১৬টি সংবাদ মাধ্যমকে তা জানায়। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এসএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে এই ম্যালয়্যার তৈরি করেছে, যা আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর মেসেজ, ছবি, ইমেইল পাচার করতে যেমন সক্ষম, তেমনি কল রেকর্ড এবং গোপনে মাইক্রোফোন চালুও রাখতে পারে।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার কী, কীভাবে এটা ফোন হ্যাক করে?
এনএসওর দাবি, অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের উপর নজরদারি চালাতে তাদের এই স্পাইঅয়্যার তৈরির লক্ষ্য।
তবে তা গোপনে ব্যবহার করতে বিভিন্ন দেশের সরকার এনএসওর গ্রাহক হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি গার্ডিয়ানকে বলেন, “যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটঅয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে।
“ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে।”
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ডেটাবেইসে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহক এদের বিষয়ে তৎপর ছিল।
ওই তালিকায় এই ফোন নম্বরগুলো থাকার মানে এটা নিশ্চিত নয় যে ওই স্মার্টফোনটি পেগাসাস দিয়ে হ্যাক করা হয়েছে। তবে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ এটা দৃঢ়ভাবে মনে করে যে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল ওই নম্বরগুলো।
এই নম্বরগুলোর কিছু ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় অর্ধেকের বেশিগুলোতে পেগাসাস ম্যালওয়্যারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে গার্ডিয়ান জানিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে নজরদারির মুখে থাকা এই ব্যক্তিদের মধ্যে কারা কারা রয়েছে, তাদের নাম অচিরেই প্রকাশ করবে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।
এই ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিক ছাড়াও ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ফোন নম্বরও রয়েছে।
কোনো কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের ফোন নম্বরও থাকার কথা জানিয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, ক্ষমতাবান ওই তার স্বজনদের উপরও গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
রোববার এই তালিকা প্রকাশ শুরুর পর ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সিএনএন, রয়টার্স, নিউ ইয়রক টাইমস, এপি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিক রয়েছে।
৪৫টি দেশের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে ওই তালিকায়, তার মধ্যে ১ হাজারের বেশি নম্বর ইউরোপের দেশগুলোর।
পেগাসাসের ক্রেতা কারা?
কোন কোন দেশের সরকার পেগাসাস কিনেছে, গোপনীয়তার শর্তের অজুহাতে সে তথ্য এনএসও প্রকাশ করেনি। তবে সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় অন্তত ৪৫টি দেশে পেগাসাসাস ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
দেশগুলো হল: আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, মিশর, ফ্রান্স, গ্রিস, ভারত, ইরাক, ইসরায়েল, আইভরি কোস্ট, জর্ডান, কাজাখস্তান, কেনিয়া, কুয়েত, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লেবানন, লিবিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন অঞ্চল, পোল্যান্ড, কাতার, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া।
অবশ্য ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, কোনো দেশে কোনো ফোন পেগাসাসের কবলে পড়েছে মানেই যে ওই দেশের সরকার ওই স্পাইওয়্যারের ক্রেতা, তেমনটা নাও হতে পারে।
দ্য অয়্যার জানিয়েছে, ভারতের ৩০০টি নম্বরের মধ্যে ৪০ জন সাংবাদিক, বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা, এক বিচারপতি, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন সংস্থার সাবেক ও বর্তমান ব্যক্তিদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী সরকারের দুই মন্ত্রীর নম্বরও রয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে অয়্যার জানিয়েছে, এই নম্বরগুলো ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আড়িপাতার লক্ষ্যবস্তু ছিল। ২০১৯ সালেই ভারতে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল।
পেগাসাস কেলেঙ্কারি নিয়ে শোরগোল ওঠায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতির খবর এসেছে টাইমস অব ইন্ডিয়ায়।
তাতে দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন থাকার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে যে ধরনের খবর এসেছে, তা ভিত্তিহীন। নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ফোনে আড়িপাতার যে অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই।
বেআইনিভাবে কোনো ফোনে আড়ি পাতা হয় না দাবি করে ভারত সরকার বলেছে, দেশের স্বার্থে যদি সরকারি কোনো সংস্থার আড়ি পাততেই হয়, তবে তারও সুস্পষ্ট নিয়ম রয়েছে, যা অনুসরণ করা হয়।
দ্য অয়্যার বলেছে, আড়ি পাতার অভিযোগ অস্বীকার করলেও ইসরাইলি পেগাসাস সফটওয়্যার কেনার বিষয়টি সরাসরি নাকচ করেনি ভারত সরকার।
এনএসও দাবি করেছি, তারা সরকারি কোনো সংস্থার কাছে সফটঅয়্যারটি বিক্রির পর তার পরিচালনার দায়িত্বে আর থাকে না, ফলে গ্রাহকের লক্ষ্যবস্তুর বিষয়ক কোনো তথ্যও তাদের হাতে আসে না।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি দাবি করেছে, তাদের গ্রাহকদের নিয়ে ‘ভুয়া’ কথা ছড়ানো হচ্ছে।
তবে পেগাসেসের কোনো অপব্যবহার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানিয়েছে এনএসও।
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এনএসও অন্তত ৪০টি দেশের সামরিক বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পেগাসাস বিক্রি করেছে।
তবে ইসরায়েলি সংস্থাটি দাবি করেছে, কোনো দেশের কাছে সফটঅয়্যারটি বিক্রির আগে সে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়।
এনএসও কোন দেশের কাছে নজরদারির কী সরঞ্জাম বিক্রি করছে, তার উপর নজর থাকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তাদের অনুমোদনের পরই কেবল তা বিক্রি করতে পারে।