২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার,সকাল ১১:৪৯

চলছে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ; হত্যাকান্ড কি পরিকল্পিত!

প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২০

  • শেয়ার করুন

বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকান্ড পূর্বপরিকল্পিত কি-না এমন প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে বিজিবির চেকপোস্টে সিনহার পরিচয় জানার পর সেলুট দেয়া হয়। অথচ অল্প দূরে এপিবিএন চেকপোস্টে এক দুই মিনিটে এমন কি ঘটেছিল তার পরিচয় জানার সাথে সাথে গুলি করা হলো? এটিই এখন বড় রহস্য মনে করছেন তদন্তকারীরা। সেই রহস্যের খোঁজে র‌্যাব মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করছেন হত্যাকান্ডের মূল আসামি ওসি প্রদীপ, লিয়াকত ও নন্দ দুলালসহ ৬ আসামিকে। রিমান্ডে থাকা অন্য তিনজন আসামি হলেন এপিবিএনের তিন সদস্য যথাক্রমে- সাব ইন্সপেক্টর মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও কনস্টেবল মো. আবদুল্লাহ।

তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাব ইতোমধ্যে আসামিদের মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে খতিয়ে দেখছে পাওয়া তথ্যগুলো। তবে জিজ্ঞাসাবাদে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকান্ডটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ছিল কি-না সেই বিষয়টিও খতিয়ে দেখছেন বলে জানা গেছে। গত ৩১ জুলাই (শুক্রবার) রাত ৯টা ২২ মিনিটে মেজর (অব.) সিনহা মো: রাশেদ খান তাঁর ডকুমেন্টারি ফ্লিম তৈরির টিমের সদস্য সাহেদুর রহমান সিফাতসহ নিজেই গাড়ি চালিয়ে মেরিন ড্রাইভ রোড হয়ে কক্সবাজার আসছিলেন। মেরিন ড্রাইভ রোডের শীলখালী বিজিবি চেকপোস্টে মেজর (অব:) সিনহার গাড়ি পৌঁছতেই সেখানে দায়িত্বপালনরত বিজিবির সদস্যদের তিনি নিজের পরিচয় দেন। বিজিবি ২ সদস্য সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে (২৪ সেকেন্ডে ৪ বার) স্যালুট দেন। একই সময়ে সিনহাও তাদের সাথে কুশল বিনিময় করেন।

শীলখালী বিজিবি চেকপোস্টের সিসিটিভি ফুটেজে ধারণকৃত সেদিনের দৃশ্যের বর্ণনা মতে রাত ৯.৫৫ টায় মেজর (অব.) সিনহার গাড়িটি বিজিবির চেকপোস্ট পার হয়ে যাওয়ার পর টেকনাফ মডেল থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বিজিবি চেকপোস্ট ক্রস করে (২টি মাইক্রোসহ) শামলাপুর এপিবিএন এর চেকপোস্টের দিকে আসেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মেজর (অব.) সিনহা বিজিবি চেকপোস্ট থেকে বাহারছরা শামলাপুর এপিবিএন-এর চেকপোস্টে পৌঁছেন ৬ মিনিটে। সেখানে দায়িত্ব পালনরত এপিবিএন-এর সদস্যরা মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে হাতে ইশারা করে সিনহার গাড়ি ছেড়ে দিতেই প্রায় দু’গজ দূরে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে থাকা ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ‘গাড়ি ছাড়ছো কেন, গাড়ি থামাও’ বলে এপিবিএনের সদস্যদের নির্দেশ দেন। ইশারা পেয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হওয়া সিনহা তখন গাড়ি থামিয়ে ফেলেন। এর মধ্যেই লিয়াকত তার বাম হাতে পিস্তল ও ডান হাতে জোরে ধাক্কা দিয়ে সিনহার গাড়ির সামনে সেখানে আগে থেকেই থাকা একটি ড্রাম ফেলে দেন। তারপর পিস্তলটি হাত বদল করেন। তখন ড্রাম ফেলার বড় একটি আওয়াজ হয়। লিয়াকত গাড়িতে কে জানতে চান, সিনহা তখন আবার নিজের পরিচয় দেন। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে উত্তপ্ত কণ্ঠে ইন্সপেক্টর লিয়াকত গাড়ি থেকে সিনহাকে নামতে বলেন।

২০ সেকেন্ড থেকে ২৫ সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়ি স্টার্টে রেখে ‘কাম ডাউন’, ‘ওকে নামছি’, ‘আচ্ছা বাবা নামছি’ বলে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে যান। মেজর (অব.) সিনহা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পরিবেশের ক্ষিপ্রতা বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিনি দু’হাত উঁচু করে নামেন। তখন লিয়াকত মেজর (অব.) সিনহা নামটা শুনার সাথে সাথেই দেরি না করে পর পর ৩টি গুলি ছুড়েন। তাতেই সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এর পর পর সেখানে পৌঁছান ওসি প্রদীপ। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে তখনও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন এবং পানি ও অক্সিজেন চাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে পানি-অক্সিজেন তো দেয়া হয়নি বরং প্রদীপ তার মুখে পা দিয়ে চেপে ধরে আরো দু’টি গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে বলে এমন কথাও বলেছেন অনেকে।

প্রশ্ন উঠছে মাত্র ৬ মিনিট আগে বিজিবির শীলখালী চেকপোস্টে বিজিবির সদস্যরা যাকে ৪ বার স্যালুট দিলো, তাকেই এপিবিএন-এর চেকপোস্টে নাম শুনার সাথে সাথেই গুলি করে হত্যা করা হলো কেন? যিনি বিজিবির চেকপোস্টে নিজে গাড়ি থামিয়ে পরিচয় দিয়েছেন, কুশল বিনিময় করেছেন, স্যালুট নিয়েছেন। আবার তার বিরুদ্ধেই এপিবিএন-এর চেকপোস্টে এসে সিগন্যাল না মেনে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার এবং অস্ত্র তাক করার অভিযোগ কেন? এতেকরে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি মেজর সিনহা হত্যার ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত?

জানা গেছে, একাধিক তদন্তকারী সংস্থা এখনো পর্যন্ত এর কোনো ভিত্তি পায়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, সুরতহাল প্রতিবেদন, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, ঘটনার সময়ের সার্বিক পরিস্থিতি সবকিছু পর্যালোচনা করে বলছেন, সিনহাকে করা গুলি ডাকাতদল মনে করে নয়, ইন্সপেক্টর লিয়াকত আত্মরক্ষার জন্যও নয়। তাকে গুলি করা হয়েছিল সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য। তাই গুলিগুলো সিনহার শরীরে বিভিন্ন দুরত্বে ছুড়া হয়েছে, টার্গেট করেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ তাদের বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে মেজর (অব.) সিনহা নিহত হওয়ার পূর্বে তাঁর নিজের পিস্তল ইন্সপেক্টর লিয়াকতের দিকে তাক করার অভিযোগটি সঠিক নয় বলেও মন্তব্য করেছেন।

ঘটনাস্থলের মাত্র ৮ গজ দূর অবস্থিত একটি জামে মসজিদ। জামে মসজিদ সংলগ্ন রয়েছে নুরানী মাদরাসা। মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকেরা সবাই মসজিদের ছাদের উপরে বসে স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদে কখন ক’টায় ঈদুল আযহার জামাত অনুষ্ঠিত হবে তার ঘোষণা শুনছিলেন। তারাসহ প্রায় অর্ধ্বশত লোক পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। গুলির শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে ঘটনা আবলোকন করেছেন।

ঘটনাস্থলের ৯/১০ গজ দূরে একটা বাজার। পরদিন ঈদুল আযহা হওয়ায় বাজারেও তখন শত শত মানুষ ছিল। তাদের অনেকেও ঘটনাস্থলের আশপাশ দিয়ে আসা যাওয়া করেছেন। তাদের অনেকেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তারা সকলেই ঘটনার উপরোক্ত বর্ণনা দিয়েছেন। যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। আবার একই ধরনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, মেজর (অব.) সিনহা মো: রাশেদ খানের গাড়িতে থাকা তাঁর ডকুমেন্টারি ফ্লিম তৈরির টিমের সদস্য সাহেদুর রহমান সিফাত।

অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ ঘটনা প্রবাহ সার্বিক পর্যালোচনা করে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকান্ড ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ কি-না এনিয়ে সন্দেহ করছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন হলো- মেজর (অব.) সিনহার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে কেন তাকে গুলি করা হলো। মেজর (অব.) সিনহাকে কিছু বলতে ও জানতে দেয়া হলো না কেন। তখন তো মেজর (অব.) সিনহার আচরণ ছিলো বিনয়ী ও নম্র। তারপরও দেড়-দু’মিনিটের ব্যবধানে মেজর অব. সিনহাকে হত্যা করা হলো কেন? আর তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ আগে থেকে টেকনাফ থানা থেকে রওয়ানা দিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাল কেন?

এদিকে, মাত্র দেড়-দু’মিনিটের ব্যবধানে মেজর অব. সিনহা হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ায় প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যায়ন করে পেশাদারিত্বের সাথে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন, র‌্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার। তিনি বলেন, সেদিন এমন কি ঘটেছিল, যার জন্য মাত্র দেড়-দু’মিনিটে মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যা করতে হলো। সেটাই তদন্ত কর্মকর্তা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন। কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার বলেন, এই হত্যাকান্ডের তদন্তে কোনো প্রকৃত দোষী যাতে আইনের আওতা থেকে বাদ পড়ে না যায় এবং কোনো নিরপরাধী যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সেজন্য সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সাথে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন