আম্পানে ১৮৮৩ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং ২০ হাজার শিশুসহ হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে রাস্তায় ও আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। আম্পানের আঘাতে গৃহহীন হওয়া পরিবারগুলোর দ্রুত পূনর্বাসনের ব্যবস্থা, যথেষ্ট খাদ্য সহায়তা এবং সুপেয় পানির সরবারহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এ প্রেক্ষিতে বৃহত্তর খুলনা উন্নয়নের মাস্টারপ্ল্যানের অংশবিশেষ কয়রা উপজেলায় প্রশস্ত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদন জানিয়েছে বানভাসি কয়রাবাসী।
প্রধানমন্ত্রীর মহানুভব দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিন শতাধিক মানুষের স্বাক্ষরসহ ৫ দফা সুপারিশ উল্লেখ করে রোববার (২৮ জুন) দুপুরে খুলনা জেলা প্রশাসকের নিকট এ আবেদন জমা দেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে রাজধানীতে আম্ফান দূর্গত উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজ ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
আবেদনে উল্লেখিত সুপারিশগুলোর মধ্যের রয়েছে;
প্রথম: পাইকগাছার সোলাদানা থেকে বামে গড়ুইখালী ও গিলাবাড়ি হয়ে কয়রার কাঠকাটা লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত সড়কটি মহাসড়কের মাস্টার প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত করা। এটি হলে খুলনা থেকে কয়রা উপজেলার দুরত্ব প্রায় ৪০ কি.মি. কমবে এবং চার লেনের এই সড়কটি বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনভিত্তিক ইকোট্যুরিজম এবং বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রীক ব্লু ইকোনমির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটবে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে টহলরত নৌবাহিনীকে স্থলপথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অনায়াসে অতি দ্রুত ব্যাপক সহযোগিতা করতে পারবে।
দ্বিতীয়: কয়রা উপজেলার আংটিহারার সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের নৌ যোগাযোগের ইতিহাস রয়েছে যা শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ পর্যন্ত বর্ধিত করা যেতে পারে। শ্রীলংকা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে যাচ্ছে যার আঞ্চলিক সুবিধার অংশবিশেষ আংটিহারাতে একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করা যেতে পারে। খুলনার রূপসা নদীর নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। রূপসা সেতুর কারণে বড় জাহাজগুলো খুলনা শিপ ইয়ার্ডে জোয়ারের সময় আনয়ন করা সম্ভব হয় না। এজন্য খুলনা শিপ ইয়ার্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কয়রার আংটিহারাতে পরিকল্পিতভাবে জাহাজ নির্মাণ বা মেরামত শিল্পের বিকাশ ঘটানো যেতে পারে। কয়রা উপজেলার প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় এ ধরনের ডকইয়ার্ড নির্মাণ কাজে এবং তদপরবর্তী সময়ে ডকইয়ার্ডটি পূর্ণ গতিতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এর ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারের জাতীয় রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে বহুগুন।
তৃতীয়: বাংলাদেশের বৃহত্তম উপজেলা শ্যামনগর এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা কয়রাকে একটি মাস্টার প্ল্যানের আওতায় আনয়নপূর্বক প্রস্তাবিত টেকসই বেড়িবাঁধ কমপক্ষে ৪০ থেকে ৪৫ ফুট প্রশস্ত করা যেতে পারে। আশেপাশে নদীতে প্রচুর বালু রয়েছে। ড্রেজিং করলে নদী গভীর হবে, নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং খুব কম খরচে বাঁধ প্রশস্ত করা সম্ভব।
অপরপক্ষে, মাটিতে আগের তুলনায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাটির বাঁধ মোটেই টেকসই নয়। বরং, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে কংক্রিটের বাঁধ এবং প্রশস্ত কার্পেটিং রাস্তা জাতীয় আয় বর্ধক। একটি ডিভইডার দিয়ে একাংশ-আনুমানিক ২০ থেকে ২২ ফুট আপাতত: কার্পেটিং করা যেতে পারে এবং বাকি অংশ ২০ থেকে ২২ ফুট সরকারের সক্ষমতা অনুযায়ী ধীরে ধীরে কার্পেটিং বা উন্নয়ন করা যেতে পারে। টেকসই এবং প্রশস্ত বাঁধ নির্মিত না হলে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোন বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে না। আর বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে না। উল্লেখ্য, ব্লক সিস্টেম ৮ থেকে ১০ বৎসরের মধ্যে বিনষ্ট হয়ে যায় এবং বারবার মেরামত করতে হয় যা দীর্ঘমেয়াদী ফল বয়ে আনে না।
চতুর্থ: বাঁধের ভিতরে এবং বাইরে সামাজিক বনায়ন করলে বাঁধটি যেমন দীর্ঘস্থায়ী হবে তেমনি ইকোটুরিজমসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। নদীর তীরে গোলপাতা, নদীর চরে কেওড়া, সুন্দরী, খলিশা, বাইন ইত্যাদি রোপন করা যেতে পারে। এর ফলে একদিকে উন্নত মানের মধু পাওযা যাবে, কেওড়ার আচার, জেলি, কেওড়া জল ইত্যাদি হাইপার টেনশন নিরোধক হিসেবে মার্কেটে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তেমনি গোলপাতা ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করলে টিনের ব্যবহার কমবে যা পরিবেশের জন্য সহায়ক। সর্বোপরি, সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর এর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের শিল্পায়ন করা যেতে পারে অনায়াসে। বেড়িবাধের ভিতরেও তাল, নারিকেল এবং দেশিজাতের প্রচুর ফলের চাষ করা যেতে পারে যার মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণপুর্বক রপ্তানি করা যেতে পারে। ইউএনডিপির সহযোগিতায় গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে এ ধরনের সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে অনায়াসে।
পঞ্চম: কয়রা উপজেলায় ২১টি স্লুইচ গেইট রয়েছে। উপকূলবর্তী এই স্লুইসগেটগুলো নির্মাণ ও সংস্কারপূর্বক বর্ষাকালের মিঠাপানির সংরক্ষণ এবং লবণাক্ত পানি প্রবেশ সীমিত বা বাধা সৃষ্টি করতে পারলে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও মিঠা পানির মৎস্য এমনকি মিঠা পানির চিংড়ি চাষের ব্যাপক সমপ্রসারণ করা সম্ভব। উল্লেখ্য, কাঁকড়া চাষের জন্য পানির পিএইচ প্রয়োজন হয় ২২ অথবা তদুর্ধ্ব। অর্থাৎ, চিংড়ি চাষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বা তিনগুন লবণাক্ত পানির প্রয়োজন হয়। সামগ্রিকভাবে পরিবেশের সুষ্ঠু সংরক্ষণের স্বার্থে বাঁধের অভ্যন্তরে কাঁকড়া চাষের আওতামুক্ত রাখা প্রয়োজন।
আম্ফান দূর্গত উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি:
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মাথায় রেখে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দূর্গত উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজ ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের পাশাপাশি বাঁধ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য জরুরী তহবিল গঠন ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
রোববার (২৮ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি চত্ত্বরে নাগরিক সংগঠন সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা লিডার্স আয়োজিত এক মানববন্ধন ও সমাবেশ থেকে এই দাবি তুলে ধরা হয়।
করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র। সমাবেশে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র মিহির বিশ্বাস, উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের আমিনুর রসুল বাবুল, কেএনএইচ জার্মানির প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান মুকুল, স্ক্যান সভাপতি জাহাঙ্গীর নাকির, সাংবাদিক আব্দুল্লাহ মুয়াজ ও তৌফিক অরিন, এনসিসিবি’র মাহবুবুর রহমান অপু, লিডার্সের খাদিমুল ইসলাম, উন্নয়ন কর্মী ইমরান হোসেন প্রমূখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আবারো জানান দিলো, যতই সংস্কার করা হোক না কেন, ৬০ দশকে তৈরি করা আয়তনে ছোট উপকূলীয় বেড়িবাঁধ কোনভাবেই ওই অঞ্চলকে সুরক্ষা দিতে পারবে না। তাই দ্রুত জলবাযু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগকে বিবেচনায় রেখে নতুন পরিকল্পনায় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাঁধের নিচে ১০০ ফুট ও উপরে ৩০ ফুট চওড়া করতে হবে। যার উচ্চতা ৩০ ফুট করার সুপারিশ করেন তারা।
বক্তারা বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। দূর্গত এলাকার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের দূর্ভোগ লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ নেই।