২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,রাত ১:২৪

প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বর্ণাঢ্য জীবনের ইতিবৃত্ত

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২০

  • শেয়ার করুন

ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মানুষটি ছিলেন অন্যরকম। তার রুচি, চাওয়া-পাওয়া অন্য দশটা লোকের সঙ্গে মেলে না। দীর্ঘ একটা সময় ধরে ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্খিত আইনজীবী। অর্থ উপার্জন করেছেন দুই হাতে। কিন্তু তেমন কিছুই রাখেননি নিজের কাছে। সব দান করেছেন চিকিৎসা সেবায়।

আজ শনিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন আইনের বাতিঘর খ্যাত এই আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

বেঁচে থাকলে আগামী বছর ২৮ ফেব্রুয়ারিতে আইন পেশায় ৬২ বছরে পা রাখতেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রিটেনের নাগরিক হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুড়িতে। বিশাল অভিজ্ঞতা, বিশাল খ্যাতির শিখরে অবস্থান করা এই প্রবীণ আইনজীবীর জীবনের অন্তরালে ছড়িয়ে আছে তাঁর আরো অনেক কৃতিত্ব। তিনি এক অনন্য সমাজসেবী। অন্য রকম এক মানুষ।

ছাত্রজীবনে রাজনীতি করলেও পেশাগত জীবনে তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হননি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা সবাই তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছেন। জাতীয় নেতাদের কাছে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ- সবার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের পক্ষেও আইনি লড়াই করেছেন তিনি। আবার তাঁদের অপকর্মের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। সব সময় উচিত কথা বলেন। কখনো কারো রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন প্রবীণ এই আইনজীবী। কিন্তু কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি। এরশাদ সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। প্রতীকী সম্মানী এক টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এক টাকা তুলতে দুই টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে, সে কারণে তাও নেননি। নিজের স্বাধীনতাকে জিম্মি করে কাজ করেননি কখনো।

আইনের এই বাতিঘরের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। বাবা মুমিন-উল হক পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। আর মা নূরজাহান বেগম। তবে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে কলকাতার চেতলায়। পরিবারের সবাই চেতলাতেই থাকতেন। পড়াশোনা করেছেন চেতলা স্কুলে। চেতলা এখন কলকাতার অন্তর্ভুক্ত। চেতলা স্কুলে রফিক-উল হকের পরিবারের সবাই পড়াশোনা করেছেন।

আলাপচারিতায় তিনি এই প্রতিবেদক এর সঙ্গে স্মৃতিবিজড়িত চেতলা স্কুলের কথা মনে করে তিনি নিজেও যেন সেই স্কুলেই ফিরে যান। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেই ১৯৪১ সালে একজন ব্যারিস্টার ১০০ টাকা দিয়েছিলেন স্কুলের পিকনিক করার জন্য। যেদিন পিকনিক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেদিন মারা যান এক কবি। এ কারণে পিকনিক বন্ধ হয়ে যায়।’ তিনিসহ অন্য সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা বলতে থাকেন, কোন এক কবি মারা গেছেন, এতে পিকনিক বন্ধ হয়ে গেল! পরে জানতে পারলেন, তিনি ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই ছোট্ট বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত না হলেও পরে তিনি বুঝতে পারেন, কত বড় কবি ছিলেন তিনি। রফিক-উল হক শেষ জীবনে এসেও বাড়িতে গেলে চেতলা স্কুলে একবার যেতেনই।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলো
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার রফিক বললেন তাঁর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক জীবনের কথা। বললেন, “আমার কলেজ লাইফ হচ্ছে ইসলামিয়া কলেজ। বঙ্গবন্ধুও পড়েছেন ইসলামিয়া কলেজে। থাকতাম বেকার হোস্টেলে। ওখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন। আমি যে রুমটাতে ছিলাম, তার পাশের দুটো রুমেই বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম হয়েছে। আপনারা শুনেছেন, আমি গিয়েছিলাম উদ্বোধন করতে। ২৬ ও ২৭ নম্বর রুম এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। আমি পাশের ২৪ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার ভাইয়েরাও ওখানে থেকেছে, আমিও ওখানে থেকেছি।তারপর ইউনিভার্সিটি-জীবনে কারমাইকেল হোস্টেলে থেকেছি। ওখানেও শেখ সাহেব কিছুদিন ছিলেন। আমি যখন কারমাইকেল হোস্টেলে আছি, তখন হঠাৎ একদিন শেখ সাহেব হাজির হয়েছিলেন একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে, তাঁর নামটা ভুলে গেছি। শেখ সাহেব জসিমকে (ক্যান্টিন পরিচালক) দেখে বললেন, ‘এই জসিম, আমার কাছে বাকি নেই তো!’ জসিম খাতা নিয়ে আসে, ‘হ্যাঁ সাব, ৩৬ রুপি।’ শেখ সাহেব বলেন, ‘এই! ওকে কিছু টাকা দিয়ে দে।’ এসব কিছু আজ মনে পড়ে। ইউনিভার্সিটিতে আমি রাজনীতি করতাম, সোশ্যাল সেক্রেটারি ছিলাম। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে জিতেছিলাম। তখন মুসলমান ছাত্র তো আমরা মাত্র চার-পাঁচজন। তার পরও আমি অনেক ভোটে জিতে গেলাম।

এর পরেরবার সবাই মিলে আমাকে হারাবে বলে ঠিক করল। আমার কাজ ছিল ছাত্রদের বই, ক্যান্টিন ট্যুরের ব্যবস্থা করা। তখন রাস্তার পলিটিকসে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আর যুব কংগ্রেস করতাম। কংগ্রেস বলতে ন্যাশনাল পলিটিকস না। আমি তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তখন আমার নেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সেন্ট্রাল যুব কংগ্রেসের সভাপতি আর আমি ছিলাম ওয়েস্ট বেঙ্গলে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, বহুবার মিটিং হয়েছে, কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একটা খুব বড় মিটিং করেছিলাম সল্টলেকে, ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বিধান রায় ছিলেন। সে আরেক ইতিহাস। কলকাতায় পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিলেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

আমি তো সরাসরি রাজনীতি করি না। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করেছি। তখনো ছাত্ররাজনীতি কোনো জেনারেল পলিটিকস ছিল না। রাজনীতিতে আমি ইনডাইরেক্টলি ইনভলভ হয়ে পড়েছিলাম। আমার আব্বা পলিটিকস করতেন। তিনি চব্বিশ পরগনায় মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। চব্বিশ পরগনা মানে কলকাতার পুরোটাই। সেদিক থেকে বলতে গেলে ভার্চুয়ালি আমার বাবা ছিলেন পুরো কলকাতার মেয়র। এখন তো যতটা সম্ভব ভাগ হয়ে গেছে।”

রফিক-উল হক ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। এরপর আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফৌজদারি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।

ওই বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। এরপর বার-অ্যাট-ল করতে গিয়েও তিনি ব্রিটেনে সাড়া জাগিয়ে ফেলেন। খুব ভালো ফল করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। হিন্দু আইন নিয়ে বার-অ্যাট-ল করেছেন। সেখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর তিনি জাতীয়তা পরিবর্তন করেন। পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি এ দেশে আসেন। তবে লন্ডনে পড়াশোনার সময় বেশ কষ্ট করতে হয়েছে বলে জানান ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

শিক্ষকতা জীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য যখন শুনলেন রফিক-উল হক ব্যারিস্টারিতে হিন্দু ল-তে ফার্স্ট হন, তখন তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু আইন পাঠ্য হয় তখনই। রফিক-উল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পরীক্ষক (একজামিনার) ছিলেন। তাঁর সময় ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক হোসেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, রেহমান সোবহানের স্ত্রী সালমা সোবহান ছিলেন। ড. এম জহির পরে আসেন। সবাই খুব নামকরা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করে খুব তৃপ্তিতে থাকতেন ব্যারিস্টার রফিক।

পরিবার প্রিয়জন
ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চিকিৎসক স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ২০১১ সালে। পারিবারিক জীবনে তাঁদের একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক। তিনিও আইন পেশায় জড়িত। ওই আলাপে ব্যারিস্টার রফিক বলেন, ‘২০১১ সালে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে আমি খুব একাকিত্ব ফিল করি। প্রতিটি মুহূর্ত এই যাতনা আমার ওপর ভর করে। তবে ছেলেবউ, একমাত্র নাতনি আর বাড়ির অন্য সদস্যদের সাহচর্য সেই মানসিক যাতনা দূরে ঠেলে দেয়।’

রফিক-উল হকও ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। স্টমাক ক্যান্সার হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে অপারেশন হয়। স্টমাকটি অপসারণ করা হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। একই সঙ্গে তাঁর বাঁ পাঁজরের তিনটি হাড়ও অপসারণ করতে হয়। তার পরও তাঁর মধ্যে উচ্ছলতার কমতি ছিল না। অবসরে বই পড়তেন আর ক্রিকেট খেলা দেখার প্রতি ছিল বেশ দুর্বলতা। বেশির ভাগ খেলাই তিনি টেলিভিশনে দেখতেন।

সমাজসেবায় জীবনের সব অর্থ
জীবনের উপার্জিত অর্থের সবই ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানবতার সেবায়। একটি টাকাও রাখেননি নিজের ব্যাংক হিসাবে। জীবনের বড় ইচ্ছাই মানুষের সেবা করা; সেই লক্ষ্য থেকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এখন একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সুবর্ণ ক্লিনিক; ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলেন রফিক-উল হক। আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদানসহ নানা সহযোগিতা দিতেন। ঢাকায় তাঁর নিজের সম্পদ বলতে একটি বাড়ি আর দু-তিন কাঠার একটি প্লট। ব্যারিস্টার রফিক বলতেন, ‘আমি আমার উত্তরসূরিদের জন্য একটি টাকাও ব্যাংকে রেখে যেতে চাই না। মানবতার সেবায় সব কিছু ইনভেস্ট করতে চাই।’

বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষায় তিনি ছিলেন সচেষ্ট
দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার রফিক সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের দাবি তুলেছেন অনেকবার। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে তিনি সব সময় উচ্চকণ্ঠে দাবি তুলেছেন। বিচারব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে সত্যিকারের আইনের বিচার প্রতিষ্ঠা হলে দুর্নীতি থাকত না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতো। দেশে যেন আইন মানার জন্য নয়, ভাঙার মধ্যেই সবাই কৃতিত্ব দেখেন। সাধারণ মানুষই শুধু নয়, মন্ত্রী-এমপি আর পুলিশ- সবাই আইন ভাঙেন। এভাবে দেশ চলতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে আদালত চলতে পারে না। বিচারক নিয়োগে রাজনীতি হয়। বিচারকাজেও রাজনীতি হয়। এসব রোধে একটি নীতিমালা প্রয়োজন। এই নীতিমালা রাজনৈতিকভাবে বিচারক নিয়োগ রোধে সহায়ক হবে।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায় ফাঁস হওয়ার ঘটনায়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার। সাকা চৌধুরীর মামলার রায় আগের দিন ফাঁস হয়। ওই ঘটনার পর ব্যারিস্টার রফিক বলেছিলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করে। রায় ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে।’

ন্যায্য কথায় অনড়
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কারো রক্ষচক্ষুকে ভয় পাননি। সরাসরি সমালোচনা করতে পছন্দ করতেন। যা ন্যায়, যা সত্য, তার পক্ষে থাকতেন। এ কারণে রাজনীতি বা আদালতের যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি আইন ও ন্যায়সংগত কথা বলতে পছন্দ করতেন তিনি। এতে যে যা-ই মনে করুক, তিনি তাঁর মতামত প্রকাশে দ্বিধা করতেন না। রফিক উল হক বলেছিলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। কারো সঙ্গে আমার কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। ফলে সত্য কথা বলতে কোনো দ্বিধা করি না।’ সত্য কথা বলার এই উৎসাহ কোথায় পেয়েছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিখ্যাত আইনজীবী একে ব্রোহরির কথা বলেন। তিনিই নাকি সব সময় সত্য কথা বলতেন আর সত্য বলার সাহসও জোগাতেন।

দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা হোক- প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এটা চেয়েছিলেন। তাই তিনি গণতন্ত্র রক্ষায় রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রের চর্চা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই এ দুজনের পক্ষেই আইনি লড়াই করেন ব্যারিস্টার রফিক। শুধু এ দুজনেরই নয়, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী নেতাদের নামে দায়ের করা মামলাও পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার রফিক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল জলিলসহ অন্যদের পক্ষেও মামলা পরিচালনা করেন। তিনি ওই সময় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ী নেতাদের পক্ষেও মামলা পরিচালনা করেন।

জীবনের অর্জন
ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী, এখন এই প্রবীণ আইনজীবীর বয়স ৮৭ বছরের কাছাকাছি। এই বয়সে এসে জীবনের কোনো অপূর্ণতা নেই। যা চেয়েছেন, তার চেয়ে বেশিই পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। ২০১৪ সালে এই প্রতিবেদক এর সঙ্গে ওই আলাপচারিতায় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন নিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় জেল থেকে মুক্ত করে এনেছি। আবার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াকেও জেল থেকে মুক্ত করতে পেরেছি। এটাই বড় পাওয়া। এখন আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। নিজেকে একটু ব্যর্থ মনে হয় দুই নেত্রীকে এখনো একসঙ্গে বসাতে না পারায়।’

একটি সুন্দর বাংলাদেশের চেহারা দেখতে এখনো অধীর অপেক্ষা এই প্রবীণের। বলেন, ‘অল্প দিন হলো স্বাধীন হওয়া এই দেশটি অনেক দেশের চেয়ে বেশ ভালো আছে। আরো এগিয়ে যাবে। এই দেশে একদিন হানাহানি, সহিংসতা আর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হবেই।’ ১৯৬২ সালে লিংকনস ইন -এ ডাক পান। তার পিতা মুমিন উল হক।

রফিকুল ১৯৬০ সালে কলকাতা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে বারের সদস্য হন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা উচ্চ আদালতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে অ্যাডভোকেট হিসাবে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালে তিনি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন।

দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও আইন বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন সুপ্রিমকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক। তিনি ১৯৯০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা তথা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কোনো সম্মানী নেননি সদ্য প্রয়াত এ আইনজীবী। পেশাগত জীবনে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হননি।

২০০৬-০৮ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় তত্কালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপার্সন ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার অভিযোগ আনা হয়। ওইসময় তিনি তাদের দু’জনের পরামর্শক ছিলেন।

২০১১ সালে স্ত্রী ডা. ফরিদা হককে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন দেশবরেণ্য এই আইনজীবী। এরপর থেকে তার ব্যক্তিগত ড্রাইভারই তার দেখাশোনা করেন।

২০১৭ সালে বাম পায়ের হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পর থেকে তার চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে পায়ে ব্যথা হওয়ায় সে কারণে হুইলচেয়ারে যাওয়া-আসা করতেন। পুরানা পল্টনের ছায়াশীতল, নিরিবিলি বাড়িতেই থাকতেন বেশিরভাগ সময়। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া আদালতেও তেমন যাননি।

রক্ত শূন্যতা ও প্রস্রাবের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেখা দিলে গত ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় মগবাজারের আদ-দ্বীন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় প্রখ্যাত এই আইনজীবীকে। অসুস্থতা নিয়ে রাজধানীর মগবাজারে অবস্থিত আদ-দ্বীন হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।

গত ১৭ অক্টোবর কিছুটা সুস্থবোধ করলে সকালের দিকে রিলিজ নিয়ে বাসায় ফিরে যান। এরপরে দুপুরের পরপরই ফের তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎিসাধীন অবস্থায় আজ সকালে না ফেরার দেশে চলে যান দেশবরেণ্য এই আইনজীবী।

তাঁদের অপকর্মের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। সব সময় উচিত কথা বলেছেন।
আজ শনিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন আইনের বাতিঘর খ্যাত এই আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

বেঁচে থাকলে আগামী বছর ২৮ ফেব্রুয়ারিতে আইন পেশায় ৬২ বছরে পা রাখতেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। শুধু বাংলাদেশেরই নয়, ভারত, পাকিস্তান ও ব্রিটেনের নাগরিক হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুড়িতে। বিশাল অভিজ্ঞতা, বিশাল খ্যাতির শিখরে অবস্থান করা এই প্রবীণ আইনজীবীর জীবনের অন্তরালে ছড়িয়ে আছে তাঁর আরো অনেক কৃতিত্ব। তিনি এক অনন্য সমাজসেবী। অন্য রকম এক মানুষ।

ছাত্রজীবনে রাজনীতি করলেও পেশাগত জীবনে তিনি কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হননি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা সবাই তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছেন। জাতীয় নেতাদের কাছে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ- সবার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের পক্ষেও আইনি লড়াই করেছেন তিনি। আবার তাঁদের অপকর্মের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। সব সময় উচিত কথা বলেন। কখনো কারো রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইনি বিষয় নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন প্রবীণ এই আইনজীবী। কিন্তু কখনো কোনো পারিশ্রমিক নেননি। এরশাদ সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। কিন্তু কোনো সম্মানী নেননি। প্রতীকী সম্মানী এক টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও এক টাকা তুলতে দুই টাকার স্ট্যাম্প লাগাতে হবে, সে কারণে তাও নেননি। নিজের স্বাধীনতাকে জিম্মি করে কাজ করেননি কখনো।

আইনের এই বাতিঘরের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতার সুবর্ণপুর গ্রামে। বাবা মুমিন-উল হক পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। আর মা নূরজাহান বেগম। তবে তাঁর বাল্যকাল কেটেছে কলকাতার চেতলায়। পরিবারের সবাই চেতলাতেই থাকতেন। পড়াশোনা করেছেন চেতলা স্কুলে। চেতলা এখন কলকাতার অন্তর্ভুক্ত। চেতলা স্কুলে রফিক-উল হকের পরিবারের সবাই পড়াশোনা করেছেন।

২০১৪ সালে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপচারিতায় স্মৃতিবিজড়িত চেতলা স্কুলের কথা মনে করে তিনি নিজেও যেন সেই স্কুলেই ফিরে যান। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেই ১৯৪১ সালে একজন ব্যারিস্টার ১০০ টাকা দিয়েছিলেন স্কুলের পিকনিক করার জন্য। যেদিন পিকনিক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেদিন মারা যান এক কবি। এ কারণে পিকনিক বন্ধ হয়ে যায়।’ তিনিসহ অন্য সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা বলতে থাকেন, কোন এক কবি মারা গেছেন, এতে পিকনিক বন্ধ হয়ে গেল! পরে জানতে পারলেন, তিনি ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই ছোট্ট বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত না হলেও পরে তিনি বুঝতে পারেন, কত বড় কবি ছিলেন তিনি। রফিক-উল হক শেষ জীবনে এসেও বাড়িতে গেলে চেতলা স্কুলে একবার যেতেনই।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলো
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার রফিক বললেন তাঁর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক জীবনের কথা। বললেন, “আমার কলেজ লাইফ হচ্ছে ইসলামিয়া কলেজ। বঙ্গবন্ধুও পড়েছেন ইসলামিয়া কলেজে। থাকতাম বেকার হোস্টেলে। ওখানেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন। আমি যে রুমটাতে ছিলাম, তার পাশের দুটো রুমেই বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম হয়েছে। আপনারা শুনেছেন, আমি গিয়েছিলাম উদ্বোধন করতে। ২৬ ও ২৭ নম্বর রুম এখন বঙ্গবন্ধু জাদুঘর। আমি পাশের ২৪ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার ভাইয়েরাও ওখানে থেকেছে, আমিও ওখানে থেকেছি।তারপর ইউনিভার্সিটি-জীবনে কারমাইকেল হোস্টেলে থেকেছি। ওখানেও শেখ সাহেব কিছুদিন ছিলেন। আমি যখন কারমাইকেল হোস্টেলে আছি, তখন হঠাৎ একদিন শেখ সাহেব হাজির হয়েছিলেন একজন অ্যাডভোকেটের সঙ্গে, তাঁর নামটা ভুলে গেছি। শেখ সাহেব জসিমকে (ক্যান্টিন পরিচালক) দেখে বললেন, ‘এই জসিম, আমার কাছে বাকি নেই তো!’ জসিম খাতা নিয়ে আসে, ‘হ্যাঁ সাব, ৩৬ রুপি।’ শেখ সাহেব বলেন, ‘এই! ওকে কিছু টাকা দিয়ে দে।’ এসব কিছু আজ মনে পড়ে। ইউনিভার্সিটিতে আমি রাজনীতি করতাম, সোশ্যাল সেক্রেটারি ছিলাম। নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করে জিতেছিলাম। তখন মুসলমান ছাত্র তো আমরা মাত্র চার-পাঁচজন। তার পরও আমি অনেক ভোটে জিতে গেলাম।

এর পরেরবার সবাই মিলে আমাকে হারাবে বলে ঠিক করল। আমার কাজ ছিল ছাত্রদের বই, ক্যান্টিন ট্যুরের ব্যবস্থা করা। তখন রাস্তার পলিটিকসে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আর যুব কংগ্রেস করতাম। কংগ্রেস বলতে ন্যাশনাল পলিটিকস না। আমি তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। তখন আমার নেত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন সেন্ট্রাল যুব কংগ্রেসের সভাপতি আর আমি ছিলাম ওয়েস্ট বেঙ্গলে। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে, বহুবার মিটিং হয়েছে, কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একটা খুব বড় মিটিং করেছিলাম সল্টলেকে, ইন্দিরা গান্ধী, নেহরু, বিধান রায় ছিলেন। সে আরেক ইতিহাস। কলকাতায় পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিলেন ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

আমি তো সরাসরি রাজনীতি করি না। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করেছি। তখনো ছাত্ররাজনীতি কোনো জেনারেল পলিটিকস ছিল না। রাজনীতিতে আমি ইনডাইরেক্টলি ইনভলভ হয়ে পড়েছিলাম। আমার আব্বা পলিটিকস করতেন। তিনি চব্বিশ পরগনায় মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। চব্বিশ পরগনা মানে কলকাতার পুরোটাই। সেদিক থেকে বলতে গেলে ভার্চুয়ালি আমার বাবা ছিলেন পুরো কলকাতার মেয়র। এখন তো যতটা সম্ভব ভাগ হয়ে গেছে।”

রফিক-উল হক ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং ১৯৫৭ সালে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৮ সালে এলএলবি পাস করেন। এরপর আইনজীবী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে তৎকালীন পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৬৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ১৯৭৩ সালে আপিল বিভাগে সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফৌজদারি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।

ওই বিষয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। এরপর বার-অ্যাট-ল করতে গিয়েও তিনি ব্রিটেনে সাড়া জাগিয়ে ফেলেন। খুব ভালো ফল করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। হিন্দু আইন নিয়ে বার-অ্যাট-ল করেছেন। সেখানেও প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর তিনি জাতীয়তা পরিবর্তন করেন। পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে তিনি এ দেশে আসেন। তবে লন্ডনে পড়াশোনার সময় বেশ কষ্ট করতে হয়েছে বলে জানান ব্যারিস্টার রফিক-উল হক।

শিক্ষকতা জীবন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য যখন শুনলেন রফিক-উল হক ব্যারিস্টারিতে হিন্দু ল-তে ফার্স্ট হন, তখন তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়ে নেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু আইন পাঠ্য হয় তখনই। রফিক-উল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পরীক্ষক (একজামিনার) ছিলেন। তাঁর সময় ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক হোসেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, রেহমান সোবহানের স্ত্রী সালমা সোবহান ছিলেন। ড. এম জহির পরে আসেন। সবাই খুব নামকরা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কাজ করে খুব তৃপ্তিতে থাকতেন ব্যারিস্টার রফিক।

পরিবার প্রিয়জন
ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চিকিৎসক স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ২০১১ সালে। পারিবারিক জীবনে তাঁদের একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিমুল হক। তিনিও আইন পেশায় জড়িত। ওই আলাপে ব্যারিস্টার রফিক বলেন, ‘২০১১ সালে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে আমি খুব একাকিত্ব ফিল করি। প্রতিটি মুহূর্ত এই যাতনা আমার ওপর ভর করে। তবে ছেলেবউ, একমাত্র নাতনি আর বাড়ির অন্য সদস্যদের সাহচর্য সেই মানসিক যাতনা দূরে ঠেলে দেয়।’

রফিক-উল হকও ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। স্টমাক ক্যান্সার হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে অপারেশন হয়। স্টমাকটি অপসারণ করা হয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। একই সঙ্গে তাঁর বাঁ পাঁজরের তিনটি হাড়ও অপসারণ করতে হয়। তার পরও তাঁর মধ্যে উচ্ছলতার কমতি ছিল না। অবসরে বই পড়তেন আর ক্রিকেট খেলা দেখার প্রতি ছিল বেশ দুর্বলতা। বেশির ভাগ খেলাই তিনি টেলিভিশনে দেখতেন।

সমাজসেবায় জীবনের সব অর্থ
জীবনের উপার্জিত অর্থের সবই ব্যয় করেছেন সমাজসেবায়। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মানবতার সেবায়। একটি টাকাও রাখেননি নিজের ব্যাংক হিসাবে। জীবনের বড় ইচ্ছাই মানুষের সেবা করা; সেই লক্ষ্য থেকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন বেশ কয়েকটি হাসপাতাল, এতিমখানা, মসজিদ ও মেডিক্যাল কলেজ। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এখন একটি ১০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সুবর্ণ ক্লিনিক; ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন। বারডেম হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ ও নূরজাহান ওয়ার্ড, আহ্ছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলেন রফিক-উল হক। আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ ২৫টিরও বেশি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনুদানসহ নানা সহযোগিতা দিতেন। ঢাকায় তাঁর নিজের সম্পদ বলতে একটি বাড়ি আর দু-তিন কাঠার একটি প্লট। ব্যারিস্টার রফিক বলতেন, ‘আমি আমার উত্তরসূরিদের জন্য একটি টাকাও ব্যাংকে রেখে যেতে চাই না। মানবতার সেবায় সব কিছু ইনভেস্ট করতে চাই।’

বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষায় তিনি ছিলেন সচেষ্ট
দেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য ব্যারিস্টার রফিক সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের দাবি তুলেছেন অনেকবার। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে তিনি সব সময় উচ্চকণ্ঠে দাবি তুলেছেন। বিচারব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে সত্যিকারের আইনের বিচার প্রতিষ্ঠা হলে দুর্নীতি থাকত না। সুশাসন প্রতিষ্ঠা হতো। দেশে যেন আইন মানার জন্য নয়, ভাঙার মধ্যেই সবাই কৃতিত্ব দেখেন। সাধারণ মানুষই শুধু নয়, মন্ত্রী-এমপি আর পুলিশ- সবাই আইন ভাঙেন। এভাবে দেশ চলতে পারে না। রাজনৈতিকভাবে আদালত চলতে পারে না। বিচারক নিয়োগে রাজনীতি হয়। বিচারকাজেও রাজনীতি হয়। এসব রোধে একটি নীতিমালা প্রয়োজন। এই নীতিমালা রাজনৈতিকভাবে বিচারক নিয়োগ রোধে সহায়ক হবে।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায় ফাঁস হওয়ার ঘটনায়ও তিনি ছিলেন সোচ্চার। সাকা চৌধুরীর মামলার রায় আগের দিন ফাঁস হয়। ওই ঘটনার পর ব্যারিস্টার রফিক বলেছিলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করে। রায় ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে।’

ন্যায্য কথায় অনড়
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক কারো রক্ষচক্ষুকে ভয় পাননি। সরাসরি সমালোচনা করতে পছন্দ করতেন। যা ন্যায়, যা সত্য, তার পক্ষে থাকতেন। এ কারণে রাজনীতি বা আদালতের যেকোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি আইন ও ন্যায়সংগত কথা বলতে পছন্দ করতেন তিনি। এতে যে যা-ই মনে করুক, তিনি তাঁর মতামত প্রকাশে দ্বিধা করতেন না। রফিক উল হক বলেছিলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। কারো সঙ্গে আমার কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। ফলে সত্য কথা বলতে কোনো দ্বিধা করি না।’ সত্য কথা বলার এই উৎসাহ কোথায় পেয়েছেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিখ্যাত আইনজীবী একে ব্রোহরির কথা বলেন। তিনিই নাকি সব সময় সত্য কথা বলতেন আর সত্য বলার সাহসও জোগাতেন।

দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা হোক- প্রবীণ আইনজীবী হিসেবে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এটা চেয়েছিলেন। তাই তিনি গণতন্ত্র রক্ষায় রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্রের চর্চা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই এ দুজনের পক্ষেই আইনি লড়াই করেন ব্যারিস্টার রফিক। শুধু এ দুজনেরই নয়, তারেক রহমান, আরাফাত রহমান কোকোসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ও প্রভাবশালী নেতাদের নামে দায়ের করা মামলাও পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার রফিক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল জলিলসহ অন্যদের পক্ষেও মামলা পরিচালনা করেন। তিনি ওই সময় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ী নেতাদের পক্ষেও মামলা পরিচালনা করেন।

জীবনের অর্জন
ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী, এখন এই প্রবীণ আইনজীবীর বয়স ৮৭ বছরের কাছাকাছি। এই বয়সে এসে জীবনের কোনো অপূর্ণতা নেই। যা চেয়েছেন, তার চেয়ে বেশিই পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা। ২০১৪ সালে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে ওই আলাপচারিতায় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন নিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাকেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় জেল থেকে মুক্ত করে এনেছি। আবার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াকেও জেল থেকে মুক্ত করতে পেরেছি। এটাই বড় পাওয়া। এখন আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। নিজেকে একটু ব্যর্থ মনে হয় দুই নেত্রীকে এখনো একসঙ্গে বসাতে না পারায়।’

একটি সুন্দর বাংলাদেশের চেহারা দেখতে এখনো অধীর অপেক্ষা এই প্রবীণের। বলেন, ‘অল্প দিন হলো স্বাধীন হওয়া এই দেশটি অনেক দেশের চেয়ে বেশ ভালো আছে। আরো এগিয়ে যাবে। এই দেশে একদিন হানাহানি, সহিংসতা আর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হবেই।’

সকাল সাড়ে ১০টায় আদ্-দ্বীন হাসপাতাল সংলগ্ন মসজিদে ব্যারিস্টার রফিকের প্রথম জানাজার পর মরদেহ পল্টনের বাড়িতে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে মরদেহে নেওয়া হবে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। বাদ জোহর সেখানে জানাজার পর মরদেহ নেওয়া হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জানাজার পর বিকালে ব্যারিস্টার রফিককে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন