১৭ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার,সন্ধ্যা ৬:০৪

ছয় বছরেও চালু হয়নি বেনাপোল ও গোড়পাড়ার মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২১

  • শেয়ার করুন

মিলন হোসেন বেনাপোল।
জেলার বেনাপোল ও শার্শার গোড়পাড়া বাজারে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দুইটি ১০ শষ্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র (হাসপাতাল) ৬ বছর আগে নির্মিত হলেও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই দুই এলাকার হাজার হাজার মা ও শিশুরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের টানাপড়োনের কারণে এর কার্যক্রম শুরু হতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটির উদ্বোধন এবং কার্যক্রম চালু হবে এমন তোড়জোরে বছর ৫ আগে এখানে ২/৪টি চেয়ার টেবিল ও কয়েকটি রোগীদের বেড আনা হয়। সেগুলোও এখন নষ্ট হওয়ার পথে। এ কেন্দ্রের জন্য এখনও কোন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সরজ্ঞাম ব্যবহার না করায় অবস্থা এমন হয়েছে ছয় বছর আগের নির্মাণ করা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দরজা জানলাসহ ভবন দুটির রংসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নস্ট হয়ে পড়ছে।
এলাকাবাসী বলছেন, উপজেলাটির গুরুত্ব অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি হলেও কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষ। দ্রুত চিকিৎসা সেবা না পেয়ে প্রায়ই জীবন হারাচ্ছেন গর্ভবতী মা ও শিশু। কর্তৃপক্ষ বলছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম শুরু হবে।
সংশ্লিস্ট সূত্রে জানা গেছে, মা ও শিশুদের সেবা নিশ্চিত করতে সরকার উন্নয়ন খাতে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৪৭টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১৩ সালে যশোরের বেনাপোল বন্দরের তালশারি ও শার্শা উপজেলার নিজামপুর ইউনিয়নের গোড়পাড়া বাজারে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ শষ্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র দুইটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালে নির্মাণ কাজ শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। হস্তান্তরের ছয় বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থার কার্যক্রম চলছে না। ফলে বন্দরনগরী বেনাপোল ও নিজামপুর ইউনিয়নের গোড়পাড়ার মানুষসহ এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মা ও শিশুরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থলবন্দর বেনাপোলে চাকরি ব্যবসাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করে বন্দরে। জরুরি কোন দুর্ঘটনায় কোন শ্রমিক আহত হলে বা কোন প্রসূতির জরুরি ডেলিভারির প্রয়োজন হলে তাকে বেনাপোল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হয়। রোগীর অবস্থা খারাপ হলে যশোর সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করাতে হয়। ৩৮ কিলোমিটার যাওযার সময় অনেকে পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ নিয়ে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে চরম ক্ষোভ। এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ছিল এবার তারা চিকিৎসা সেবা পাবেন। বিনা চিকিৎসায় আর কোনো গর্ভবতী নারীর জীবন ঝরবে না। কিন্তু স্বপ্নের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ হলেও ছয় বছরেও চিকিৎসক নিয়োগ না হওয়ায় সেবা মেলেনি।
বেনাপোল পৌরসভায় ১ লাখ ৩০ হাজার এবং এ থানার আওতায় আরও তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে অন্তত আড়াই লাখ মানুষের বসবাসের জন্য এখনো গড়ে ওঠেনি সরকারি ভাবে কোন হাসপাতাল বা চিকিৎসা কেন্দ্র। বেসরকারি ভাবে যেসব চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো আছে তাতে নেই পর্যাপ্ত কোন ডাক্তারের ব্যবস্থা। সপ্তাহে এক দুই দিন সেখানে রোগি দেখতে ডাক্তার আসে দূর-দুরান্ত থেকে। অপারেশন করতেও ডাক্তার আনতে হয় যশোর ও সাতক্ষীরা থেকে।
সীমান্ত ঘেঁষা এ বন্দরের মানুষ নানা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দক্ষিণাঞ্চলের সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রাণকেন্দ্র বেনাপোল বন্দর। প্রতি বছর এ বন্দর থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করলেও এখানে এখনো কোন হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ এখান থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করলেও এখানে বন্দরের কয়েক হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বন্দর ব্যবহারকারীদের জন্য কিছুই করেনি। অথচ এই বন্দর থেকে আয় করে অন্য বন্দরের উন্নয়ন করছেন। এখানকার মানুষ দাবি করতে করতে হাফিয়ে উঠেছে। সে কারনে এখন আর কোন দাবির কথাই বলেন না।
বেনাপোলের বাসিন্দা সংবাদকর্মী সোহাগ হোসেন জানান, গত মাসে তার মেয়ে গর্ভবতী অবস্থায় তার বাড়িতে ছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হলে তাকে শার্শা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার তাকে যশোর নিতে বলেন। যশোরের ডাক্তাররা তাকে দেখেনি। পরে খুলনা নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, বাড়ির কাছেই স্থলবন্দর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। কিন্তু সেটি চিকিৎসকের অভাবে চালু হয়নি। এখানে সেবা পেলে হয়ত মেয়েকে হারাতে হতো না।
বেনাপোল ১০ শষ্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের অফিস সহকারি রুস্তম আলী জানান, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি চালু হলে এখানে এই জনপদের অনেক মানুষ উপকৃত হবে। তবে এটি চালু না হওয়ায় ভবনটিতে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। রাতে অচেনা মানুষ প্রাচীরের উপর দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে নেশা করে। তাদের আমরা কিছু বলতে পারি না। কারন তারা এলাকার উঠতি বয়সের তরুন ছেলেরা।
বেনাপোল মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার আব্দুর রাজ্জাক জানান, এখানে একটি পুরাতন জরাজীর্ন বিল্ডিং ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেখানে চিকিৎসা দিতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। বর্তমান সরকার মা ও শিশুদের ভাল স্বাস্থ্য সেবা দিতে এখানে ৩ বছর আগে ১০ শষ্যার একটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করলেও তা এখনো উদ্বোধন করা হয়নি। সম্প্রতি কিছু আসবাব পত্র আসছে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রচেষ্টায়। শুনেছি আগামী বছরের প্রথম দিকে এর কার্যক্রম শুরু হবে।
অন্যদিকে নিজামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ২৮ হাজার ১৮৯ জন মানুষের বসবাস। কিন্তু গোড়পাড়া বাজারে স্থাপিত মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় ছয় বছর যাবত সাধারণ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
শার্শার নিজামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার নিতু জানান, গত মাসে তার এক আত্মীয় গর্ভাবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিধিনিষেধের কারণে যানবাহন চলছিল না। মোটরসাইকেলে বসিয়ে যশোর নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
বেনাপোল পৌর মেয়র আশরাফুল আলম লিটন বলেন, এতদিনেও মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র দুটি চালু না হওয়ায় মায়েরাও সেবা বঞ্চিত। গুরুতর অসুস্থরা দূর-দূরান্তে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পথে রাস্তায় জীবন দিচ্ছে। চিকিৎসা কেন্দ্র দুটি চালু করতে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমরা আশাবাদী।
শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর আলিফ রেজা জানান, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র দুটি চালু হওয়া জরুরি। বিষয়টি সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দেখছে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবগত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শার্শা উপজেলা মা, শিশু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মেডিকেল অফিসার আবু বক্কর ছিদ্দিক জানান, উপজেলায় দুটি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আপাতত পাঁচটি করে বেড ও চেয়ার টেবিল সরবরাহ করা হয়েছে। চিকিৎসার যন্ত্রপাতি বরাদ্দ হয়নি। সরকারের পরিকল্পনা ছিল একসঙ্গে সবগুলো সেবা কেন্দ্র চালু করবে। কিন্তু পদ অনুমোদন ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে এতদিন নিয়োগ হয়নি।
তিনি আরও জানান, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০২০ সালে জানুয়ারিতে আবেদন গ্রহণ শেষ হয়। প্রত্যেক মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে দুই জন চিকিৎসক, দুই জন নার্সসহ মোট ১৮ জন জনবল থাকবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই আশা করা যাচ্ছে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরু হবে।
জনবল না থাকায় হাসপাতালটি চালু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন। তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর হাসপাতালটি নির্মাণের পর স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে তারা কার্যক্রম চালু করতে পারেনি।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন