৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার,রাত ১২:১৩

খুলনার চরমপন্থি নেতা শিমুল যেভাবে হয়ে ওঠেন আমানুল্লাহ

প্রকাশিত: মে ২৩, ২০২৪

  • শেয়ার করুন

ডেস্ক রিপোর্ট:

খুলনার অপরাধ জগতের সম্রাট খ্যাত শিমুল ভূঁইয়া এলাকাবাসীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। এখনো তার নামে ওই অঞ্চলে চলে অন্ধকার দুনিয়ার সব কায়কারবার। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য আর ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া ওরফে শিপলু ভূঁইয়া ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। খুলনার এই ভূঁইয়া পরিবারের খুনের ইতিহাসও বেশ দীর্ঘ বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। ঘটনাটি এখন সারাদেশে আলোচনায়। এরই মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়ার নাম। যাকে এমপি আনারের ভাড়াটে খুনি বলছে পুলিশ। ঢাকায় গ্রেফতার হওয়ার পর শিমুল ভূঁইয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছেন, তার নাম সৈয়দ আমানুল্লাহ।
কিন্তু খুলনার শীর্ষ চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া কীভাবে হয়ে ওঠেন সৈয়দ আমানুল্লাহ? কীভাবেইবা খুনের রাজনীতিতে তার উত্থান? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) অন্যতম শীর্ষ নেতা। ভাই শিপলু ভূঁইয়া ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার পর শিমুলের পাসপোর্টে বসিয়ে দেওয়া হয় আমানুল্লাহ নামটি। আমানুল্লাহ নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তিনি ভারতে যাওয়া-আসা করতেন।
এমনকি ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করতে একই ভুয়া নামে জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) বানিয়ে নেন শিমুল। শিমুল থেকে আমানুল্লাহ হয়ে ওঠা এবং কীভাবে তিনি ভুয়া পাসপোর্ট ও ভুয়া এনআইডি তৈরি করলেন, এগুলোই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে এসেছে।
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিমুল ছাড়াও তার পরিবারের আরও তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা হলেন- শিমুলের স্ত্রী সাবিনা মুক্তা, বড় ভাই লাকি ভূঁইয়া ও ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া।
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে শিমুল ভূঁইয়া গ্রেফতার হবার পর আবারও আলোচনায় এসেছে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর এলাকার এই পরিবারের ইতিহাস। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দামোদরের অপর প্রভাবশালী সরদার পরিবারের সাথে ভূঁইয়া পরিবারের দ্বন্দ্ব অর্ধশত বছরের বেশী সময় ধরে চলে আসছে। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে দুই পরিবারের ৪ জন খুন হয়েছেন। তবুুও দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব এতটুকুও কমেনি।
এলাকাবাসী ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে ফুলতলা উপজেলা নকশাল বাহিনীর ঘাটি ছিলো। সেই সময়ে নকশাল বাহিনীর সদস্যদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে ভূঁইয়া পরিবারের সদস্যদের। যা নিয়ে এলাকার সরদার পরিবারের সদস্যদের সাথে ভূঁইয়া পরিবারের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই সময়ে মেধাবী শিমুল রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
দামোদরের মোঃ নাসির উদ্দিন ভূইয়ার ৬ ছেলের মধ্যে চতুর্থ ফজল মোঃ ভূইয়া ওরফে শিমুল ১৯৮৫ সালে দামোদর এমএম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। দৌলতপুরের দিবা নৈশ্য কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশের পর তিনি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই সময়ে ডুমুরিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান ইমরানকে হত্যার মধ্যে দিয়ে লাইমলাইটে আসেন শিমুল। রাজশাহীতে থাকাকালে ১৯৯১ সালে যশোরের অভয়নগরে গণেশ নামে একজনকে হত্যা করে ৭ বছর জেল খাটেন তিনি। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জেলে ছিলেন শিমুল। পরবর্তীতে তিনি ২০০০ সালে আবারও ইমান নামে আরেক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দি ছিলেন। জামিনে কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি ভাড়াটে কিলার হিসেবে কাজ করতেন।
তার জেলখাটা অবস্থায় সরদার পরিবারের প্রবীণ সদস্য সরদার আবুল কাশেম জনসমর্থনের মাধ্যমে দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আরও চরম রূপ নেয়। এক পর্যায়ে ১৯৯৮ সাথে সরদার আবুল কাশেমকে হত্যার মধ্যে দিয়ে এ বিরোধে অস্ত্রের রাজনীতি প্রবেশ করে। সে ধারাবাহিকতায় খুন হন আবুল কাশেমের বড় ছেলে দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদলও। সরদার পরিবারের অভিযোগ, এ দুটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভুঁইয়া পরিবার জড়িত। কাশেম হত্যা মামলায় ভুঁইয়া পরিবারের শিমুল, শিপলু ও মমিনুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেও দণ্ডিত হয়।
পরে ২০০০ সালে যশোরের অভয়নগর এলাকায় আরেকটি হত্যা মামলায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন শিমুল।
পুলিশ জানায়, বাদল হত্যা মামলাটির বিচার চলাকালে শিমুল ভূঁইয়ার সেঝোভাই হাতকাটা মুকুল পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন। এর পেছনে বিএনপি নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠুর হাত থাকতে পারে বলে মনে করে ভূঁইয়া পরিবার। তাই ২০১৭ সালে জেলে অবস্থান করেই ফুলতলা উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান মিঠুকেও হত্যা করেন শিমুল। শিমুল জেল থেকে মুক্তি পাবার সাথে সাথে তাদের এক আত্নীয় (পুলিশ কর্মকর্তা) খুলনা থেকে যশোর গিয়ে তাকে খুলনা থানায় নিয়ে আসেন। তা না হলে সে সময় ক্রসফায়ারে মরতে হতো শিমুলকে।
এলাকাবাসী আরও জানায়, রাজশাহীতে থাকাকালীন শিমুলের যাতায়াত ছিলো ঝিনাইদহে। সেখানে পূর্ব বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) শীর্ষ নেতা আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে দাদা তপনের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। একাধিকবার জেলখাটার কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে চরমপন্থী দলে যোগদেন শিমুল। দায়িত্বপান খুলনা অঞ্চলের। এরপর তিনি ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।
২০১০ সালের আগ পর্যন্ত খুলনাঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে জনযুদ্ধ। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রমতে সেই সময়ে শিমুল ছিলেন অপ্রতিরোধ। খুলনার শীর্ষ চরমপন্থী নেতা আব্দুর রশিদ তাপু, ডুমুরিয়ার মৃনাল, শৈলেন, দেবু সবাই ছিলেন শিমুলের অধিনে। শিমুল প্রকাশ্যে না আসলেও তার নামেই চলতে থাকে সবকিছু। শিমুলের প্রভাবে সর্বশেষ খুলনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে তার স্ত্রী সাবিনা মুক্তা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন। শিমুলের ছোটভাই শিপলু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর শিমুলের পাসপোর্ট আমানউল্লাহ নামে করে দেন। যা নিয়ে শিমুল ভারতে যাতায়াত করে আসছে।
এমপি আনারকে হত্যার জন্য গত ৩০ এপ্রিল বেনাপোল দিয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় যান তিনি।
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতার অন্যান্যরা হলেন, তার স্ত্রী সাবিনা মুক্তা, বড় ভাই লাকি ভূঁইয়া ও ভাইপো তানভীর ভূঁইয়া।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন