২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার,রাত ১:১২

কাস্টমারের টাকায় বিলাসী জীবন ইভ্যালির এমডির

প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২১

  • শেয়ার করুন

অনলাইন ডেস্ক :

ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) প্রতারক প্রতিষ্ঠান ডেসটিনির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সেই এমএলএম দীক্ষা নিয়েই শুরু করেন গ্রাহক ঠকানোর নতুন ব্যবসা ইভ্যালি। অবিশ্বাস্য অফার দিয়ে গ্রাহকের টাকা নিজের কোম্পানিতে এনে বিলাসী জীবন শুরু করেন তিনি। জানা যায়, কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রাসেলের স্ত্রী শামীমা বেতন নেন ৫ লাখ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রাসেল নিজে নেন সাড়ে চার লাখ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে প্রায় ১০ লাখ টাকা বেতন নেন ইভ্যালি থেকে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির পুঁজি অবশিষ্ট নেই এক টাকাও। এ ছাড়া আগে গাড়ি চড়ার সামর্থ্য না থাকলেও ইভ্যালির প্রতারণায় ভাগ্য ঘুরে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই দামি ব্র্যান্ডের ‘রেঞ্জ রোভার’, ‘পোরশে’ ও ‘অডি’ গাড়ি ব্যবহার করছেন। মাত্র দেড় বছরের মাথায় অবিশ্বাস্য রকমের বিলাসী জীবনযাপনে হতবাক হয় অনেকেই। এরপরই শুরু হয় ইভ্যালির ধস।

রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এইচএসসি শেষ করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন রাসেল। তারপর ২০১১ সালে ঢাকা ব্যাংকে চাকরি নেন। ছাত্র অবস্থায় ডেসটিনিতে যোগ দিয়ে মানুষ ঠকানোর মোক্ষম দীক্ষাটি সেখান থেকেই নেন রাসেল। তারপর মাঝে কয়েক বছর ঢাকা ব্যাংকে চাকরি করলেও সেখানে ঠিকতে পারেননি তিনি। পরে ডেসটিনির মতো আইডিয়ায় বহুস্তরে গ্রাহক তৈরি করার প্ল্যান নিয়ে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেন ইভ্যালির মতো মানুষ ঠাকানোর ব্যবসা। জানা যায়, প্রথম দিকের কয়েক স্তরের আনুমানিক ১ হাজার গ্রাহককে তাদের পণ্য বুঝিয়ে দেয় ইভ্যালি। পণ্য বুঝে পাওয়া নির্বাচিত সেই ১ হাজার গ্রাহককে ব্যবহার করা হয় ইভ্যালির প্রচার কাজে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রচার চালাত ইভ্যালির। এ বিশাল টিমকে মনিটর করার জন্য আরো কিছু বেতনভুক্ত স্টাফকে কাজে লাগায় রাসেল। আর এই বিশাল সংখ্যার গ্রাহককে কৌশলে কোম্পানির প্রচার কাজে ব্যবহার করে গড়ে তোলেন পিরামিড আকৃতির লাখ লাখ গ্রাহক। যাদের প্রতি ১ হাজার জনের একজনকে এবং নির্দিষ্ট একটি এলাকা সিলেক্ট করে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া হতো। ই-কমার্স ব্যবসায় জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী এই প্রতিবেদককে বলেন, ইভ্যালির গ্রাহক অফার, গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহ, ব্যাংক লেনদেন, ইভ্যালির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিরপেক্ষ একটি অডিট টিম দিয়ে তদন্ত করা হলে অস্বাভাবিক দেনা ছাড়াও অজানা অনেক কাহিনি বেরিয়ে আসবে। সূত্র জানায়, আড়াই বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা দামি ব্র্যান্ডের ‘রেঞ্জ রোভার’, ‘পোরশে’, ‘অডি’ গাড়ি চালাচ্ছেন। বিলাসী তাদের জীবনযাপন। প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে তারা অর্থ-সম্পদ গড়ে তুলেছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুবাইয়ে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। ইভ্যালির এমডি ও সিইও রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন একে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। ইভ্যালির ব্যবসায় জড়িত একটি সূত্র জানায়, মোটরসাইকেল বিক্রির অফারে এক হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১০০ জনের মধ্যে সরবরাহ করা হতো। বাকি ৯০০ গ্রাহককে দিই-দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করা হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ওই এক হাজারজনের কাছ থেকে ইভ্যালি দুই লাখ টাকা মূল্যের প্রতিটি বাইকের দাম নিয়েছে এক লাখ টাকা। তাতে এক হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় হয় ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যবসার কৌশল হিসেবে এক শ গ্রাহককে বাইক সরবরাহ করা হয়। এই হিসাব অনুযায়ী এক শ বাইকের দাম হয় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাকি ৯০০ গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ইভ্যালির অ্যাকাউন্টে থেকে যেত। ইভ্যালির কর্ণধারদের আখের গোছাতে ভোগ-বিলাসে খরচ করা হতো এই টাকা। জানা গেছে, ইভ্যালি ই-কমার্স ব্যবসার জন্য নিবন্ধন গ্রহণ করে ২০১৮ সালের ১৪ মে। আনুষ্ঠানিক ব্যবসা শুরু করে একই বছরের ডিসেম্বরে। শুরুতেই তারা নানা ধরনের পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় অফার দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রাহদের আকৃষ্ট করে। বাজারের চেয়ে অস্বাভাবিক কমমূল্যে পণ্য বিক্রির একের পর এক অফার দিতে থাকে তারা। কিছু গ্রাহককে বড় অঙ্কের ডিসকাউন্ট দিয়ে পণ্য সরবরাহ করে প্রচার চালানো হতো। ২০০ থেকে ২০০ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট অফারও ছিল তাদের। এ ধরনের অফারে গ্রাহক বিনা মূল্যে অতিরিক্ত পণ্যও পেয়েছে। এতে গ্রাহকদের মধ্যে ইভ্যালির পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দারুণ মোহ সৃষ্টি হয়। কম দামে আগে পণ্য কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে বুকিং দিয়েছেন গ্রাহকরা। বর্তমানে ইভ্যালির গ্রাহকসংখ্যা কম-বেশি ৭০ লাখ বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বিপুল গ্রাহকের ১০ শতাংশকে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া হলেও পণ্য পায়নি প্রায় ৬০ লাখ গ্রাহক। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সদুত্তর দিতে পারেননি। একপর্যায়ে প্রশ্ন চেয়ে পাঠালেও তার উত্তর দেননি। ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল ও স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে ইভ্যালি ডটকমের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন