প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২৩
প্রকাশিত:
মিলন হোসেন বেনাপোল থেকে।
আন্তর্জাতিক ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি এখন চোরাকারবারীদের ট্রেনে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতিদিন দু’দেশের চোরাকারবারীরা এটাকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রেনটির ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ যাত্রী এখন লাগেজ পার্টি নামধারী চোরাকারবারী। পাসপোর্ট-ভিসার মাধ্যম ভারত ও বাংলাদেশের দুই চোরাকারবারী সিন্ডিকেট আন্তর্জাতিক এ ট্রেনটি দখল করে নিয়েছে। ট্রেনটি দখল নিয়ে প্রতিদিন ট্রেন বোঝায় করে চোরাকারবারীরা ভারতীয় মালামাল বাংলাদেশে পাচার করছে। এসব মালামালের মধ্যে রয়েছে শাড়ি, থ্রি পিস, কম্বল,কসমেটিক,শাল সোয়েটার সহ বিভিন্ন পণ্য। এসব পণ্যের ভিতরে আবার আসছে কৌশলে মাদকদ্রব্য। কাস্টমসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষভাবে ম্যানেজ করেই অবাধে দেশে ঢোকাছে এসব অবৈধ মালামাল।
এসব মালামালের প্রকৃত ভ্যাট ট্যাক্স প্রদান করলে প্রতিদিন সরকার এখান থেকে কোটি টাকার উর্ধ্বে রাজস্ব পেতো। কিছু নৈতিক স্খলন, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীও দালালদের জোগ সাজেশন এসব মালামাল পাচারকারীরা নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে পাচার করছে। আবার এসব চোরাকারবারীরা বাংলাদেশ থেকে মূল্যবান ডলার ও সোনার মত গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতে।
অথচ কাস্টমস ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে সরকার এখান থেকে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেতো। বাকি সাধারণ ১০ থেকে ৫% যে পাসপোর্ট যাত্রীরা যারা প্রকৃত টুরিস্ট ও চিকিৎসা ভিসা নিয়ে খুলনা থেকে কলকাতা ও কলকাতা থেকে বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেন তারাই পড়েছেন চরম বীপাকে। কোন প্রকৃত যাত্রী একবার ট্রেনটিতে উঠলে চোরাচালারীদের হাতে হেনস্থ শিকার হয়ে দ্বিতীয়বার ট্রেনটিতে তারা যাতায়াত করতে চায় না। ট্রেনটি এ সমস্ত অনৈতিকতার কারণে ট্রেনটি সকাল ১০ঃ৪৫ এ বেনাপোল রেল স্টেশনে পৌঁছানোর কথা থাকলেও ট্রেনটি প্রতি সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে দুই থেকে তিন ঘন্টা দেরিতে ট্রেনটি বেনাপোল রেলস্টেশনে পৌঁছায়। বেনাপোল রেলস্টেশনে পৌঁছানোর পর ট্রেনটিতে স্থানীয় মাদক ও চোরাচালানিরা হুমড়ী খেয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় চোরাকারবারী, বিজিবি, কাস্টমসও অন্যান্য সংস্থার গেম। এ গেম চলে কয়েক ঘন্টা ধরে।
মাদকসেবী-চোরাকারবারী দালাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি বেনাপোল রেলস্টেশন কাস্টমস কর্মকর্তারা
একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জোর করেই এসব লাগেজ পার্টি বা চোরাকারবারীদের ইমিগ্রেশনের ভেতরে জোর জবরদস্তি করে প্রবেশ করান। ইমিগ্রেশনের ভিতরে এক চিহ্নিত দালাল কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দাকে মোটা অংকের টাকায় ম্যানেজ করে মালামাল ট্যাক্স ভ্যাট না করিয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্য স্থানে পাচার করছে। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা স্বরব হলে সাংবাদিকদের উপরেও অগ্নি মূর্তি হয় এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এসব অনৈতিক ও অনিয়মের ফলে সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে প্রতিদিন বেনাপোল ইমিগ্রেশন কাস্টমস থেকে সরকার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব হারাচ্ছে।
রোববার বেলা বারোটার দিকে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ইমিগ্রেশনের ভিতরে এক যাত্রী ভারত থেকে বিপুল পরিমাণের মালামাল নিয়ে কাস্টমারের ভিতরে প্রবেশ করেন। এ সময়ে তার সঙ্গে একটি বড় মিষ্টি কুমড়ো ছিলো। মিষ্টি কুমড়োটি দেখে কাস্টম কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে মিষ্টি কুমড়াটি কেটে তার ভেতরে মাদকদ্রব্য দেখতে পায়। তবে দায়িত্ব কর্তব্যরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা সেগুলো নিজের হেফাজতে নিয়ে ওই ব্যক্তিকে অজ্ঞাত কারণে ছেড়ে দেন।
প্রতিনিয়ত এভাবে এসব বিপুল পরিমাণে মালামালের মধ্যে আসছে মাদকদ্রব্য। অথচ এসব চোরাকারবারীদের বা লাগেজ পার্টিদের দূরত্ব রোধ না করে বরং সাধারণ পাসপোর্ট-যাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি করছে বেনাপোল রেলস্টেশন কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দারা।
ট্রেনে কলকাতা থেকে বেনাপোল রেল স্টেশনে আসা পাসপোর্ট যাত্রী শাহ আলম, রমেন,শেখা, রত্না সহ একাধিক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ট্রেনটি এখন চোরাকারবারীদের ট্রেনে রূপান্তরিত হয়েছে। ট্রেনটির নাম ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ না দিয়ে ট্রেনটি চোরাচালানী ট্রেন নাম হওয়ায় প্রয়োজন ছিলো। এ ট্রেনের শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ যাত্রী চোরাচালানি ও লেগেস পার্টি। তারা কলকাতা থেকে ট্রেনটিতে ওঠার সময়ে বিপুল পরিমাণে মালামাল নিয়ে ওঠে। তারা এমনভাবে মালামাল ট্রেনে রাখে যেন ট্রেনটি একটা সরকারি গোডাউন। বাথরুম থেকে শুরু করে দরজা জানালার সামনে মালামালের পাহাড় তৈরি করে। যে কারণে একজন সাধারণ ভ্রমণকারী বা চিকিৎসা করতে যাওয়া যাত্রীরা এসব মালামাল ভাড়িয়ে বাথরুমেও যেতে পারে না।
প্রতিবাদ করলে এসব চোরাকারবারী ও লেগেস পার্টির সিন্ডিকেটের লোকজন এসব যাত্রীদের উপর চড়াও হয় এমনকি শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত করে। যে কারণে ট্রেনটিতে দিন দিন সাধারণ টুরিস্ট ও ভারতের চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীরা ট্রেনটিতে যাতায়াত কমে যাচ্ছে।
’বন্ধন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন যাত্রীবাহী ট্রেন। ভারত-বাংলাদেশের সাথে সৌহার্দ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সুদীর্ঘ ৫২ বছর পর ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ ট্রেন টি চালু হয়। দু’দেশের মানুষের সহজে আরামদায়ক যাতায়াতের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ৯ই নভেম্বর ট্রেনটি দু’দেশের মধ্যে যাত্রা শুরু করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতা থেকে বাংলাদেশের খুলনা শহরের ১৭২ কিলোমিটারের মধ্যে যাতায়াত করে। এর মধ্যে বাংলাদেশে পড়েছে ৯৫ কিলোমিটার ও ভারতে পড়েছে ৭৭ কিলোমিটার। এটিই ভারত বাংলাদেশের সাথে সোহার্দ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্বিতীয় ট্রেনও বটে।
ট্রেনের ৪৫৬ আসনের মধ্যে ৩১২টি এসি চেয়ার ও ১৪৪টি প্রথম শ্রেণির আসন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রেনে কেবিনের সিট ভাড়া ভ্রমণ করসহ ২ হাজার ২৫৫ টাকা ও চেয়ার কোচের ভাড়া ভ্রমণ করসহ ১ হাজার ৫৩৫ টাকা। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য ৫০ শতাংশ ছাড় প্রযোজ্য ।
‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ সকাল ৭টা ১০ মিনিটে কলকাতা থেকে যাত্রী নিয়ে সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে বেনাপোল স্টেশনে পৌঁছানোর নির্ধারিত সময়। ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শেষে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে খুলনার উদ্দেশে রওনা দিয়ে পৌঁছানোর কথা ১২টা ৩০ মিনিটে। দুপুর দেড়টায় খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে বেনাপোলে পৌঁছানোর কথা বিকাল ৩টা ১৫ মিনিটে। বেনাপোল ইমিগ্রেশনের কার্যক্রম শেষে বিকাল ৪টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টার আগে নির্ধারিত সময়ের আগে কখনোই বাংলাদেশ থেকে ভারতে ছেড়ে যেতে পারে না ট্রেনটি।
খুলনা থেকে কলকাতা ও কলকাতা থেকে খুলনা এ ১৭২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রমের জন্য ৪ ঘন্টা ৫০ মিনিট থেকে ৪ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চোরাচালনী ব্যাপক তৎপরতা ও কাস্টমসের অনৈতিক কার্যাবলীর কারণে ট্রেনটি ২ ঘন্টা থেকে তিন ঘন্টার নির্ধারিত সময়ের বেশি সময় নিয়ে যাতায়াত করে থাকে। যেটা সাধারণ যাত্রীদের জন্য চরম দুর্ভোগের।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ২০২০ সালের ১৫ মার্চ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে রেল পরিষেবাটি বন্ধ করে ভারত সরকার। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময়ে বন্ধ থাকার পর বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমতে থাকলে আবারো ২০২২ সালের ২৯ শে মে ট্রেনটি চালু হয়।
বেনাপোল রেলওয়ে ইমিগ্রেশন মাহবুব রহমান জানান, বেনাপোল ও কলকাতা রেলওয়ে ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের ব্যাগেজ পরীক্ষা ও পাসপোর্ট কার্যক্রম সম্পূর্ণ হচ্ছে। যাত্রীরা যাতে দ্রুত গন্তব্যে যেতে পারে তার জন্য আন্তরিক হয়ে কাজ করছে পুলিশ সদস্যরা।
বেনাপোল রেল স্টেশন মাস্টার সাইদুর বলেন, করোনা মহামারীর কারণে প্রায় দুই বছর যাবত ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ভারতীয় সরকার বন্ধ করে দেয়। বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমতে থাকলে আবারো ২০২২ সালের ২৯ শে মে ট্রেনটি চালু হয়। কিন্তু ট্রেনটিতে বেশ কিছুদিন যাবত লাগেজ পার্টি ও চোরাকারবারীদের দৌরত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমি বিষয়টি উদ্বোধন কর্তৃপক্ষ কে জানিয়েছি। কিন্তু কোনভাবেই কাজ হচ্ছে না। এসব কারণে সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে ট্রেনটি দুই থেকে আড়াই ঘন্টা দেরি করে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তাছাড়া এখানে কাস্টমসেও কিছু সমস্যার কারণে আরো এক ঘন্টা দেরি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি আমার উদ্বোধন কর্মকর্তাকে জানিয়েছি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানালে বিষয়টি সমাধান হওয়া সম্ভব ।