২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,সন্ধ্যা ৭:২৫

কয়রায় ভাঙন কবলিত এলাকায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৩

  • শেয়ার করুন

তথ্য প্রতিবেদক : খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রার কপোতাক্ষ নদ ও শাকবাড়িয়া নদীর ভাঙন কবলিত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের হিড়িক পড়েছে। ড্রেজার মেশিন দিয়ে উত্তোলিত এসব বালু বিভিন্ন জলাশয় ও ফসলি জমি ভরাট করে মজুদ রাখা হচ্ছে। পরে বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যক্তির চাহিদা মতো সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে নদী ভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি হওয়াসহ সরকার বিশাল অংকের টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
স্থানীয়দের সাথে বহিরাগত বালু ব্যবসায়ীর বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য ড্রেজার মেশিন দিয়ে কপোতাক্ষ ও সাকবাড়িয়া নদীর ভাঙ্গন কবলিত স্থান থেকে বালু উত্তোলন করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ নদীর বাগালী ইউনিয়নের নারানপুর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, মহারাজপুরের মেঘারআইট হাফিজিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন এলাকা, উত্তর বেদকাশির গাববুনিয়য়া নামক স্থান, কাশিরহাট খোলা, দক্ষিণ বেদকাশীর মেদেরচর, শাকবাড়িয়া নদীর হরিহরপুরসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধে ভাঙন কবলিত বিভিন্ন এলাকা থেকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু উত্তোলনের ফলে কোনো কোনো স্থানে বাঁধের ভাঙন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে যেকোনো জলোচ্ছ্বাসে, নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোতে ইতোমধ্যে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার।
সরেজমিনে উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর মেঘারআইট হাফিজিয়া মাদ্রাসার সামনে কপোতাক্ষ নদের মাঝখানে ও তীর ঘেঁষে কয়েকটি ড্রেজার মেশিন বসানো। এর প্রতিটি মেশিনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়েকটি বাল্কহেড। প্রতিটি বোটে ১০/১২ জন লোকের পাহারায় বালু তোলা হচ্ছে। সেই বালু বাল্কহেডের মাধ্যমে পাউবোর বেঁড়িবাধ কেটে শত শত ফুট পাইপ জুড়ে উত্তোলিত বালু অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এসময় সাংবাদিকদের ক্যামেরা দেখে ড্রেজারের পাশে বালু উত্তোলনের কর্মচারী শহিদ জানান, তারা প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে শামীম নামের এক মালিকের হয়ে বালু উত্তোলন করছেন। তার মালিক আটঘাট বেঁধে বালু উত্তোলনে নেমেছেন। এ ব্যাপারে তিনি আর কিছু জানেন না।
মল্লিক লোড ড্রেজারের মালিক শামীম জানান, তারা একটি রাস্তার উন্নয়ন কাজের বালু দিতে চালনা থেকে এসেছেন। প্রথমে তারা অনেক ভোগান্তিতে পড়ছিলেন। পরে উর্দ্ধতন মহলকে ম্যানেজ করে বালু উত্তোলন করছেন।
উপজেলার কয়েকটি গ্রামের একাধিক গ্রামবাসী বালু উত্তোলনের কারণে দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, এই অবৈধ বালু উত্তোলন আমাদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়বে। আমাদের গ্রাম নদী ভাঙ্গনে গ্রাস করে নিচ্ছে। তারা অভিযোগ করে বলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের মহ উৎসবে নেমেছে প্রভাবশালী বালু দস্যুরা। বিষয়টি দেখেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসন, এমনকি পাউবো’র সংশ্লিষ্টরা নীরবতা পালন করছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় অর্ধ লক্ষ ফুট টানা বালু উত্তোলনের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে বেড়িবাঁধ ভাঙন আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়রার সুশীল সমাজ ও স্থানীয় ভুক্তভোগীরা।

মেঘার আইট গ্রামের বাইজিদ হোসেন বলেন, আমাদের বাড়ি-ঘর সব নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শুধু মাত্র অবৈধভাবে ভাঙন এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করাতে নদী ভাঙছে। এটা প্রতিরোধ না করলে, নদী ভাঙতেই থাকবে। আর আমাদের মতো মানুষের বার বার লবণ পানিতে ঘর বাড়ি সব কিছু হারাতে হবে। বালু উত্তোলনের সঙ্গে প্রভাবশালী একটি চক্র জড়িত। তারা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিকে ম্যানেজ করে এটা করে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না।তাদের টাকা আছে, আমরা গরিব মানুষ। কথা বললে বিপদে ফেলে দেবে। আমরা নদী ভাঙন রোধে পদক্ষেপ চাই। পাশাপাশি অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে পরিবেশ আন্দোলনকারী সংগঠন সবুজ আন্দোলনের কয়রার সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, নদীভাঙ্গনের ফলে প্রতি বছর কয়রা উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। অতিশীঘ্রই নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ করা না হলে, কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি উপকূল রক্ষা বাঁধ কোনোভাবেই টিকবে না। তিনি দ্রুত নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধের জোর দাবি জানান।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: কামাল হোসেন এর সাথে এ ব্যাপারে কথা হলে, তিনি এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা বলেন।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, কয়রা উপজেলার নদীর যেকোনো পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। নদীর যে স্থান থেকে বালু তোলা হয় তার চার পাশে ধসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য প্রশাসনকে অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। তা হলেই সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে তিনি জানিয়েছেন।
খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, যারা অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন