২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার,রাত ২:২০

ঋনের জালে বন্দি জেলেদের শুটকির জন্য সমুদ্রযাত্রা

প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২৩

  • শেয়ার করুন

আবুল হাসান, মোংলা : রফিকুল ইসলাম (৫২)। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা গ্রামের বাসিন্দা। একসময় ছিলেন সুন্দরবনের দূর্ধষ্য বনদস্যু। তবে সেসব ছেড়ে এখন তিনি পেশাদার জেলে। দীর্ঘ চার বছর যাবৎ সাগরে মাছ ধরেন তিনি। এই মাছ ধরতে গিয়ে মহাজনের ঋনের জালে আটকে গেছেন রফিকুল। প্রায় ২০ লাখ টাকা দাদন নিয়ে এখনও তা শোধ করতে পারেননি তিনি।

জীবিকা এবং পেশার তাগিদে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার মনতোষ সরকারও (৫৫) ঋনের জালে বন্দি। মহাজনের এই ঋন থেকে মুক্তি মিলছেনা একই উপজেলার মধুসুদন বিশ^াস (৪৮), বিশ^নাথ সরকার (৪২), মোংলা উপজেলার সোনাইলতলা হাবিবুর রহমান শেখেরও (৪৫)। এরকম হাজার হাজার জেলে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে শোধ করতে পারেনি টাকা। তাই বাধ্য হয়েই এই পেশা ছাড়তেও পারছেন না তারা। বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) দুপুরে মোংলার পশুর নদীর চিলা পাড়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে জানা যায় এসব কথা।

এসব জেলেদের এইবার ঋন শোধ করতেই হবে, সে কথা মাথায় রেখে শুটকি তৈরিতে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে ছুটছেন উপকূলের প্রায় ১০ হাজার জেলে। তাই শেষ মুহুর্তের ব্যস্ততা উপকূলের জেলে-মহাজনদের মাঝে। সাগরে যেতে যে যার মত প্রস্তত করেছেন জাল, দড়ি, নৌকা ও ট্রলার। অনেকেই আবার সাগরে যাওয়ার প্রস্ততি নিয়ে ইতোমধ্যে চলে এসেছেন মোংলা ও পশুর নদীর চিলা পাড়ে। বনবিভাগের কাছ থেকেপাসপারমিট নিয়েই এসব জেলেরা রওনা হচ্ছেন বঙ্গোপসাগর পাড়েরদুবলার চরে।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, সুন্দরবনের দক্ষিনে বিশাল চর দুবলার চর। বছরের সাত মাস এই চর ফাঁকা থাকে। এই দুবলার চর সংলগ্ন সমুদ্রে মাছ আর মাছ। আর এই মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন উপকূলের কয়েক হাজার জেলে। নভেম্বরের শুরু থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে সেখানে অস্থায়ী বসতি গড়েন তারা। গড়ে ওঠে দোকানপাটও। মাছ ধরা, শুটকি বানানো ও বিকিকিনির এই কর্মজজ্ঞ চলবে পাঁচ মাস। তবে এর বিনিময় জেলেদের জন্য কোনও সুবিধা নেই সেখানে। যদিও এই শুঁটকিপল্লী থেকে প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকার রাজস্ব পায় বনবিভাগ।

বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার জেলে আব্দুল লতিফ শেখ (৪৬) বলেন, প্রতি বছর শুটকি মৌসুমে তারা সাগরে যান। সেখানে গিয়ে অস্থায়ী বসতি গড়ে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে তা রোদে শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হয়। এ কাজে তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। তারপর এই মাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করে তাদের মহাজনেরা। তবে ঝড় জলচ্ছ¡াসে এসব জেলেদের আশ্রয় নেওয়ার কোন পাকা স্থাপনা নেই। মোটা অংকের রাজস্ব দেওয়া হলেও তাদের কথা কেউ ভাবেনা বলেও জানায় এই জেলে।

দুবলার চরে মিষ্টি পানির কোন ব্যবস্থা নেই জানিয়ে জেলে মনতোষ সরকার বলেন, সাগরে যাওয়ার সময় বড় ড্রামে করে মিষ্টি পানি নিয়ে যেতে হয়। তবে তা অল্প সময়ে ফুরিয়ে গেলে গভীর কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে খেতে হয়। এজন্য নানা রকম রোগ ব্যাধির সৃষ্টি হয়। আর তার জন্য নেই কোন চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা। মহাজনের ঋন পরিষোধ করতেই প্রতি বছর এতোসব দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে দুবলার চরে মাছ আহরণে যেতে হয় জেলেদের। এমন কথা উল্লেখ করে জেলে শহিদ মল্লিক বলেন, সংশ্লিষ্ট বন কর্তারা এসবের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তা তারা করেন না’

এদিকে জেলেদের দুঃখ দূর্দশার কথা স্বীকার করে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব বলেন, তাদের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শিগগিরই পদক্ষেপ নিবেন। এছাড়া তিনি বলেন, এবার শুটকি মৌসুমকে ঘিরে উপকূলের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩০ হাজার জেলে সমবেত হবেন দুবলার চরে। দুবলার চরের ওই সকল জেলেরা প্রায় দেড় হাজার ট্রলার নিয়ে মাছ ধরবেন গভীর সাগরে। সাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বাছাই করে শুটকি করবেন তারা।

এ বছর চরে জেলেদের থাকা ও শুটকি সংরক্ষণের জন্য এক হাজার ১০৮টি জেলে ঘর ও ৭৮টি ডিপো স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত শুটকির মৌসুমে দুবলার চর থেকে বনবিভাগের রাজস্ব আদায় হয়েছিল ছয় কোটি টাকা। আর এবার তার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত কোটি টাকা বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন