২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার,রাত ১:১৩

করোনাকে হারিয়ে দিচ্ছে শ্রমজীবীরা

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২০

  • শেয়ার করুন

নিম্ন আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কম—এমনটাই বলছেন এসংক্রান্ত কাজে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা। কেন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সংক্রমণের বহিঃপ্রকাশ কম দেখা যাচ্ছে সে বিষয়টি নজরে এসেছে তাঁদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়টি রহস্যজনক। এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে গবেষণা জরুরি।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, তাঁরা মনে করছেন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের তুলনায় নিম্ন আয়ের ও বস্তিবাসীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কারণ তাদের পরিশ্রমী জীবনযাপন।

জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ও রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও কাজ শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ফলাফল আকারে বলার মতো পর্যায়ে কাজ এগোয়নি। তবে যতটুকু পর্যবেক্ষণে এসেছে তাতে আমরাও দেখতে পাচ্ছি বস্তিবাসী যাদের পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে করোনা পজিটিভের হার খুবই কম।’

আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি যৌথভাবে এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে জানিয়ে ড. ফ্লোরা বলেন, কয়েকটি বিষয় তাঁরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে প্রথমত বস্তি বা নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন, তারা পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে কি না, উপসর্গ রয়েছে কি না, তাদের জীবনযাপন এখন কেমন?

নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি শারীরিক পরিশ্রম করায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সে সম্পর্কে ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখনো যেহেতু আমরা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক ভিত্তি পাইনি, তাই এভাবে বলা ঠিক হবে না। তবে আবার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়াও যাবে না।’ তিনি বলছিলেন, এখন তো বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনার অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও তা স্থায়ী নয়। চার-পাঁচ মাসে ওই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসতে থাকে। কিন্তু এরপর আবার সংক্রমিত হলে তখন হয়তো উপসর্গ দেখা যাবে।

ড. ফ্লোরা আরো বলেন, ভাসমান মানুষ বেশির ভাগ সময় ঘরের বাইরে বা খোলামেলা পরিবেশে কাজ করে। বদ্ধ কম জায়গায় কম কাজ করতে হয়। বাইরে থাকলে তারা তুলনামূলক বেশি শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ পায়। ফলে তারও প্রভাব থাকতে পারে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও এ ধরনের ধারণা আমাদের কারো কারো মধ্যে কাজ করে। এ ছাড়া বস্তিতে বয়স্ক মানুষ তুলনামূলকভাবে কম। করোনায় মৃত্যুর খবরও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

জেসমিন বেগম (৩৫) থাকেন কড়াইল বস্তিতে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় তিনি বস্তির প্রবেশ মুখে জয়নাল আবেদীনের দোকানে মোবাইল ফোন রিচার্জ করতে আসেন। কিন্তু তিনি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে আসেননি। সেখানে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এবং যখন তাঁকে স্বাস্থ্যবিধির কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয় তখন তিনি মুখে আঁচল টানেন। বস্তিতে করোনা সংক্রমণের বিষয়ে জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হননি। সর্দি, জ্বর, হাঁচি-কাশি এসবও হয়নি তাঁর। বস্তিতে তাঁর আশপাশে যাঁরা থাকেন তাঁদের কেউ আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনেননি।

আগে কাজ করতে বাইরে গেলেও এখন তিনি বাসায় থাকেন বলে জানালেন জেসমিন।

এখানে পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না জানতে চাইলে আনোয়ার নামের আরেক বাসিন্দা পাশ থেকে বলেন, ‘শুরু দিয়াই বস্তির ভেতরের এরশাদ মাঠে একটা বুথ বসানো অইছিল। বস্তির মাইনসেরা হেইডায় গিয়া পরীক্ষা করছে। মাস দুই থাহার পর দিন পনেরো আগে হেইডা নাহি বাড্ডায় লইয়া গেছে।’

ফোন বিচার্জের দোকানি জয়নাল বলছিলেন, ‘এইহানে সবাই তো আগের মতো চলাফেরা করতাছে, মাইনসেরা বস্তির মধ্যে বাজারগুলাতে প্রত্যেক দিন আগের মতোই বাজার করতাছে, যারা বাইরে কামকাইজে যাওয়ার হেরা যার যার কাম করতাছে। কেউ রিকশা চালাইতে যায়, কেউ যুগাইল্যার কামে যায়, কেউ মাইনের বাসাবাড়ির কামে যায়।’

ওই বস্তির একটি মাদরাসার পরিচালক ফজলুল হক প্রায় ১৫ বছর ধরে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করেন। টিঅ্যান্ডটি মাঠের পাশেই তাঁর চেম্বার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বস্তির ভেতর আমার নিয়মিত অনেক রোগী আছে। কেউ কেউ সামান্য সর্দি-জ্বর নিয়ে আসে। কিন্তু তা আগের সাধারণ সর্দি-জ্বরের মতোই। করোনা শুরুর পর আমি আর্সেনিক-৩০ ও আরো একটা ওষুধ এনে রাখছিলাম। সন্দেহজনকভাবে দুই-চারজনকে ওই ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। তারা ভালোও হয়েছে।’

ডা. ফজলুল হক বলেন, ‘করোনার উপসর্গ নিয়ে বস্তির কেউ মারা গেছে বা জটিল অবস্থায় পড়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে তেমন খবর অন্তত আমার কাছে নেই। বিষয়টি অনেকটাই কৌতূহলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—কেন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে করোনার প্রকোপ চোখে পড়ছে না?’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা বড় ভয়ে ছিলাম বস্তিবাসীদের নিয়ে। কারণ যদি কোনোভাবে এসব বস্তিতে ব্যাপক সংক্রমণ হয়, আমরা কিভাবে সামাল দেব? কারণ বস্তিতে আইসোলেশন কার্যকর করা কঠিন। এ কারণে আমরা আরবান হেলথ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সবাইকে নিয়েই বস্তিগুলোতে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করি এবং মাস্ক-সাবানসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া বস্তির অনেকে ঘরে বসেই বিভিন্ন ধরনের সাহায্য পাচ্ছে, ফলে বাইরে যাওয়ার হারও কমেছে। সব মিলিয়ে আমরা যেভাবে আশঙ্কা করেছিলাম এখন পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে আউটব্রেক হয়নি। এটা একটি খুবই ইতিবাচক দিক আমাদের জন্য।’

মমিনুর রহমান মামুন বলেন, কোনো কোনো বস্তিতে দুই-একজন পাওয়া গেছে। তাদের দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে।

জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুন নবী বলেন, ঢাকায় এখন প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৩৫-৩৬ শতাংশ হচ্ছে বস্তিবাসী ও ভাসমান। তাদের যে জীবনমানের অবস্থা তাতে করে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়লে খুবই বিপদের বিষয়। এ ক্ষেত্রে তাদের পরীক্ষার সুবিধা বা স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্তত দৃশ্যমান পর্যায়ে সংক্রমণ হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেনও বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল বোধ করছেন। তিনিও বলেন, ‘কেন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সংক্রমণের বহিঃপ্রকাশ কম দেখা যাচ্ছে তার যুক্তিসংগত বা বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাইনি। তবে অবশ্যই বিষয়টিকে সতর্কতার সঙ্গে দেখা জরুরি। কারণ যদি বস্তিগুলোতে সংক্রমণ বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে তবে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।’

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘আমরা ঢাকা মেডিক্যালসহ অন্য হাসপাতালগুলোতেও করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষ অনেকটাই কম দেখছি। আমার মনে হয়, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের চেয়ে বস্তিবাসী বা নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন বেশি রোগ প্রতিরোধমূলক। বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রম করায় নিম্ন আয়ের বা বস্তিবাসীর মধ্যে ডায়াবেটিসের মতো রোগ কম। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমরা এখনো বের করতে পারিনি।’

ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, তার মানে এটা নয় যে বস্তিবাসী বা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটছে না। হয়তো ঘটছে কিন্তু তাদের লক্ষণ মৃদু থাকছে।

ব্র্যাকের করোনা পরীক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক ডা. মোর্শেদা আক্তার বলেন, ‘আমাদের আরবান প্রজেক্ট ও আরো কিছু কাজের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীর মধ্যে করোনা পরিস্থিতি কেমন তা দেখার চেষ্টা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত সাধারণ পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে—এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে করোনার প্রকোপ কম।’

এ নিয়ে আরো ভালো করে গবেষণা প্রয়োজন উল্লেখ করে ডা. মোর্শেদা বলছিলেন, ব্যাপারটা অনেকটা রহস্যজনক এবং অনেকের জন্যই কৌতূহলোদ্দীপক।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন