প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাস্টমস অফিসের মধ্যেই পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন শাহ আলম ও আমিরুল। ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে বহনকৃত মালামালের বিপরীতে সরকারের নির্ধারিত শুল্কের স্থলে অর্ধেক পরিমান টাকা অবৈধভাবে পকেটে ভরছেন শাহ আলম ও আমিরুল। যেমন, সরকারী হিসেবে কোন ব্যবসায়ীর শুল্ক যদি লাখ টাকা হয়, তাহলে তাকে সরকারী খাতায় না তুলে বরং তার থেকে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে পকেটে ভরেন তারা। ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরা ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা ভোমরা কাস্টমস অফিসে ঢুকতেই তাদের নিয়ে ছুটোছুটি ও দেনদরবার শুরু হয় শাহ আলম এবং আমিরুলের। শুধু তাই নয়, ঢাকা, খুলনা, যশের ও বেনাপোলের কিছু বড়সড় ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়মিত চুক্তিও রয়েছে তাদের। এসব বড়সড় ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন দিয়ে বের হলে, তাদেরকে কাস্টমস অফিসে না ঢুকিয়ে সরকারী শুল্ক ফাঁকি এবং মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে ইমিগ্রেশনের বাইরে থেকেই প্রাইভেটকার বা মাইক্রোতে করে তাদেরকে গন্তব্যে চলে যেতে সহযোগীতা করেন কাস্টমস অফিসের দুই চাঁদাবাজ শাহ আলম ও আমিরুল। এমনকি তাদের সহযোগীতায় কাস্টমস অফিস এলাকা থেকে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ল্যাগেজ চুরি যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। রোববার সরেজমিনে স্থলবন্দর এলাকায় দেখা গেছে এমন চিত্র। শুধু কাস্টমস অফিসের মধ্যেই হয়রানী হচ্ছেননা পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা, অফিসেই বাইরেই রয়েছে আতংকের অপর দুই নাম কালো জাকির ও মুজিবরসহ তাদের দলবল। কাস্টমস অফিস লাগোয়া মোটর সাইকেল গ্যারেজটি বর্তমানে হয়ে উঠেছে মাদকসেবী ও চাঁদাবাজ কালো জাকির-মুজিবরসহ তাদের দলবলের অপকর্মের আঁখড়া। ওই মোটরসাইকেল গ্যারেজের অধিকাংশ ভাড়া মোটরসাইকেল চালকই কালো জাকির মুজিবর বাহিনীর সদস্য। ভারত থেকে ফেরা পাসপোর্ট যাত্রী বা ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা ভোমরার কাস্টমস অফিস থেকে বেরুলেই এ বাহিনীর সদস্যরা কৌশলে তাদেরকে ঢোকায় মোটরসাইকেল গ্যারেজে। সেখানে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে থাকে কালো জাকির বা মুজিবর। তারপর সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পরিচয় দিয়ে গ্যারেজের মধ্যেই পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখাতে শুরু করেন মাদকসেবী কালো জাকির, মুজিবরসহ তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। এরপর তারা যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের কাছে দাবী করেন মোটা অংকের চাঁদা। ভারত থেকে বহনকৃত পন্যের হারে ২ হাজার, ৫ হাজার, ১০ হাজার এমনকি কারো কারো কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্তও চাঁদা আদায় করছেন কালো জাকির ও মুজিবর। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদেরকে ওই বাহিনীর ছদ্মবেশী ভাড়া মোটরসাইকেল দিয়ে গ্যারেজ থেকে বের করে দিয়ে কিছুদুর যেতে না যেতেই ফের শ্রীরামপুর, বৈচনা, মাহমুদপুর, পদ্মশাখরাসহ বিভিন্ন নির্জন এলাকায় আটকে ফেলে কালো জাকির ও মুজিবর। এরপর তারা বিজিবি সদস্যদের দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আটকে ফেলা পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মালামাল ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার টাকা চাঁদাবাজি করেন। কখনও কখনও ব্যর্থ হয়ে এসব পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেন বিজিবি’র হাতে। রোববার বিকেলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগা থেকে বাংলাদেশে আসা অনুপ হালদার, মিতু হালদারসহ কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে পরবর্তীতে তাদের মালামাল বিজিবি দিয়ে ধরিয়ে দেয় মাদকসেবী ও চাঁদাবাজ জাকির হোসেন ওরফে কালো জাকির। পরে ওই ভুক্তভোগীদের তোপের মুখে আত্মগোপন করে কালো জাকির। দিনের পর দিন ভোমরা স্থল বন্দরের কাস্টমস অফিসসহ অফিসের বাইরে প্রকাশ্যে জাকির-মুজিবর বাহিনী এবং শাহ আলম ও আমিরুলের এমন চাঁদাবাজি ও শুল্ক ফাঁকির রমরমা কারবার চলে আসলেও এসব অপকর্ম যেন চোখে পড়েনা সীমান্তরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বন্দর প্রশাসনের।
ভোমরা স্থলবন্দরে জাকির-মুজিবর এবং শাহ আলম ও আমিরুলের হয়রানী, চাঁদাবাজির শিকার একাধিক ভুক্তভোগী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কালো জাকির ও মুজিবর বন্দর এলাকার চিহ্নিত চাঁদাবাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪টি করে ফেনসিডিল সেবন করেন কালো জাকির। পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই তাদের প্রতিদিনের আয় ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আর কাস্টমস অফিসে শুল্ক ফাঁকি এবং চাঁদাবাজির অলিখিত লাইসেন্স দিয়ে রাখা হয়েছে শাহ আলম এবং আমিরুলকে। তাদের চাঁদাবাজিকৃত অর্থের একটি অংশ চলে যায় বন্দরের অসাধূ কিছু অফিসার, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পকেটে। ফলে এসব অসাধূ আমলাদের ছত্রছায়ায় দিনদিন চিহ্নিত দালাল ও চাঁদাবাজগুলো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা মানুষের কাছে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে এবং পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীদের হয়রানী রোধে অবিলম্বে কালো জাকির-মুজিবর, শাহআলম-আমিরুলদের মতো দালাল ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বন্দরের শুল্ক গোয়েন্দা ও ইমিগ্রেশন পুলিশের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা।
স্থল বন্দরে এসব চাঁদাবাজি, শুল্ক ফাঁকি ও হয়রানীর বিষয়ে কাস্টমস অফিসের সহকারী কমিশনার আমীর মামুন সাংবাদিকদের বলেন, কালো জাকির, মুজিবর, শাহআলম ও আমিরুলে বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ পেয়েছি। ইতোমধ্যেই এবিষয়ে অভিযুক্তদের সতর্ক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের প্রক্রিয়া চলছে। হয়রানী ও শুল্ক ফাঁকি রোধে সকলের সহযোগী কামনাসহ এসব প্রতারক বা চাঁদাবাজদের খপ্পরে না পড়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ইমিগ্রেশন পুলিশের নবনিযুক্ত আই.সি মাজরিহা হুসাইন বলেন, জাকির, মুজিবরসহ চাঁদাবাজ চক্রের দৌরাত্মে পাসপোর্ট যাত্রী ও ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।