২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার,রাত ৪:৩৩

খুলনায় নতুন ভবনে নতুন আঙ্গিকে গণহত্যা জাদুঘর

প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২৪

  • শেয়ার করুন

তথ্য প্রতিবেদক:

গণহত্যা জাদুঘরের দশবছর পূর্তি উপলক্ষ্যে শুক্রবার গণহত্যা জাদুঘরের এক দশক শিরোনামে দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও মিলনমেলার আয়োজন করা হয়।
২০১৪ সালের এই দিনে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার নির্ভুল ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও অন্বেষণ এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্ম তথা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে খুলনাতে যাত্রা শুরু করেছিল গণহত্যা জাদুঘর। আজ নতুন ভবনে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করছে গণহত্যা জাদুঘর।
মোট তিনটি পর্বে এই দিনব্যাপী আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে।
সকাল ১০টায় খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সেমিনার উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনে সভাপতিত্ব করেন গণহত্যা জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। বেলা ১১ টায় শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের একাডেমিক সেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএচডি গবেষক পুনম মুখার্জি এবং পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. সাগর তরঙ্গ মন্ডল। তাদের প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড শরিফ উদ্দিন আহমদ। এই অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও আর্কাইভিস্ট ড মাহবুবর রহমান।
বিকাল ৩ টায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মূল আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান, এমপি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত দশম শহিদ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি কবি তারিক সুজাত। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক ড চৌধুরী শহীদ কাদের।
কবি তারিক সুজাত ‘যে জাদুঘর জীবনের কথা বলে’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরকে প্রচলিত সংজ্ঞায় শুধুমাত্র হিসেবে ভাবলে ভুল হবে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই জাদুঘরকে স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে হয়েছে’।
প্রধান অতিথি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে আমাদের শেকড়কে। আমাদের শেকড় হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসে গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করায় জাদুঘরের কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসায় আমরা আমাদের স্বাধীনতা আবার নতুন করে ফিরে পেয়েছি’।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজে ঘাতকদের কখনো রাজনীতি করার অধিকার থাকতে নেই। যারা পাকিস্তানের রাজনীতি করতে চায়, তাদের রাজনীতি করার বিরুদ্ধে আমি। বাংলাদেশে কখনো অন্য রাষ্ট্রের রাজনীতি চলতে পারে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের এই লড়াই আরও চালিয়ে যেতে হবে।
অনুষ্ঠানের পূর্বে প্রতিমন্ত্রীকে গণহত্যা জাদুঘরের প্রতিটি গ্যালারি ঘুরে ঘুরে দেখান অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও ড. চৌধুরী শহীদ কাদের।
অনুষ্ঠানে গণহত্যা জাদুঘরের এক দশক পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরষ্কার প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টকে ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডে ৩০ শতক জমিসহ একটি পুরাতন দ্বিতল বাড়ি প্রদান করেন। সেখানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে অত্যাধুনিক গণহত্যা জাদুঘর ভবন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ নভেম্বর ২০২৩ নতুন ভবনটি উদ্বোধন করেন।
ছয়তলা এই ভবনে মোট তিনটি গ্যালারি রয়েছে। সেখানে গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, ভাষা আন্দোলন, শহিদ বুদ্ধিজীবী, একাত্তরের ঘাতক দালাল ও শরণার্থীদের নানা নিদর্শন ও অমূল্য দলিল প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরে রয়েছে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অসংখ্য আলোকচিত্র এবং ভাষ্কর্য। নতুন এই ভবনে রয়েছে একটি অত্যাধুনিক আর্কাইভ এবং বিশাল লাইব্রেরি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই ভূখণ্ডের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে ২৫ শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নয়মাস যাবত যে পরিকল্পিত গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল তা গত শতকের গণহত্যার ইতিহাসে অন্যতম তীব্র ও বৃহৎ গণহত্যা। গণহত্যাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের নজির পৃথিবীতে বাংলাদেশ ব্যতীত আর একটিও নেই।
যেখানে গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত ছিল, সেখানে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চাতে বিজয়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিজয়কে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে গণহত্যার ইতিহাস চাপা পড়ে গিয়েছিল এবং গণহত্যাকারীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। এই পরিকল্পিত প্রক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও গণহত্যা অস্বীকারের পথ সুগম করে দিয়েছিল। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জনপ্রিয় পরিসরে গণহত্যাকে বাদ দিয়ে কেবল বিজয়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল।
গণহত্যার পরিবর্তে বিজয়ের ওপর অধিক গুরুত্বারোপের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনাতে সামরিক ও গণহত্যাকারীদের চেতনা বিস্তার লাভ শুরু করে। নতুন প্রজন্মের কাছে গণহত্যার ইতিহাস অজানায় থেকে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গণহত্যাকারীরা একদিকে গণহত্যাকে অস্বীকার করেছিল, অন্যদিকে তাদের আসল পরিচয় গোপন করে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। এই বিভ্রান্তির হাত থেকে নতুন প্রজন্মকে উদ্ধারের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোটাই একমাত্র কৌশল হিসেবে কার্যকর থাকেনি। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মূলধারার চর্চাতে দীর্ঘদিন যাবত কেবল বিজয়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
এই অচলাবস্থা দূর করে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের নির্ভুল ইতিহাস তুলে ধরার অভিপ্রায়ে গণহত্যা জাদুঘর পথচলা শুরু করে। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখী ইতিহাস চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ এবং প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে সিভিল সমাজ দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পাটাতন তৈরি করেন। তাঁর উদ্যোগে গণহত্যা ও নির্যাতনকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধের নির্ভুল ইতিহাস ও চেতনা নতুন প্রজন্ম তথা দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে ২০১৪ সালের ১৭ মে দক্ষিণের জেলা শহর খুলনায় যাত্রা শুরু করে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’।
এই জাদুঘর দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যা জাদুঘর।

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন