প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২১
মোক্তার হোসেন ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ পুরুষ তিনিও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্নের সঙ্গে এক হয়ে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে ৩৪ বছর বয়সে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দেশকে স্বাধীন করতে হবে, দেশের মানুষের মুক্তি ও বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার সার্বক্ষণিক দর্শন। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আশুতিয়া গ্রামের ছাহার উদ্দিন দাড়িয়া ও সামেত্য বেগমের বড়পুত্র ছিলেন মোক্তার হোসেন দাড়িয়া। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের বড় এবং সংসারের উপার্জন সক্ষম ছিলেন মোক্তার হোসেন। সমাজ সচেতন, পরোপকারী, আত্মীয়-স্বজনের নিকট প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন তিনি। গ্রামের লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরার জন্য ষাটের দশকের প্রথম দিকে খুলনায় চলে আসেন। চাকুরি ও ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । প্রথমে খুলনা শিপইয়ার্ডে, এরপরে বিজিএমসি তে চাকরির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন খুলনা আওয়ামী লীগের নেতা শেখ আব্দুল আজিজ, শেখ সালাউদ্দিন ইউসুফ, এম এ বারি সহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, সাবেক এমপি এম এ বারী এবং মোক্তার হোসেন একই অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন।
মোক্তার হোসেন দাড়িয়া বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ১৯৬৬ সালের এর ৬ দফা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন গণসংযোগ , সমাবেশ, মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। তিনি খুলনা শহরের মহাসিনাবাদ ইউনিয়নের নতুন বাজার অঞ্চলে বসবাস করতেন। একপর্যায়ে তিনি মহাসিনা বাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। এছাড়া শহর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭০ নির্বাচনে এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তিনি রেসকোর্স ময়দানে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। একসময়ে চাকরি জীবন ছেড়ে তিনি সম্পূর্ণভাবে রাজনীতি এবং ঠিকাদারি পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।তৎকালীন সময় খুলনা বিভাগীয় গ্রন্থাগার ভবন, মোল্লাহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স , শরণখোলা ফরেস্ট অফিসের সহ একাধিক ঠিকাদারি কাজ তার অধীনে ছিল। ১৯৬৫ সালে মোক্তার হোসেন কোটালীপাড়া উপজেলার বহলতলী গ্রামের সম্ভ্রান্ত শিকদার পরিবারের মেয়ে মেমিয়া বেগমের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে গর্ভবতী স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে খুলনা ছেড়ে নৌকাযোগে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হন। খুলনা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি পৌছাতে সময় লাগে দুই থেকে তিনদিন। বাবা-মার কাছে তাদেরকে রেখে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা শুরু করনে। এই পর্যায়ে কোটালীপাড়ার হেমায়েত বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি হেমায়েত বাহিনীতে যোগদান করেন এবং একই সাথে খুলনা অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ঠিকাদারি কাজের তদারকি এবং ব্যাংকের অর্থ তোলার জন্য যখন তিনি খুলনায় এসেছিলেন তখন স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন, মুসলিম লীগের নানা অপকর্ম দেখে তিনি তার প্রতিবাদ করেন ফলস্বরূপ তাদের টার্গেটে পরিণত হন। সে সময় রাজাকার আলবদর বাহিনী মোক্তার হোসেনের নিজস্ব এবং তার নিকটজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর দখল করে নিয়েছিলেন এবং তার প্রতিবাদ জানানো মাত্রই রাজাকারেরা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির হুমকি দেয়।খুলনায় তৎকালীন রাজাকার আলবদর বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ অঞ্চল হানাদার মুক্ত হয় । মোক্তার হোসেন পরবর্তীতে খুলনার দিকে রওনা হন। ১২ই ডিসেম্বর রূপসা নদীর পূর্বপাড়ে তার পরিচিত হক সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন। সারারাত বাংলাদেশের পতাকা সহ বিজয় উৎসব পালনের জন্য নানা প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৩ই ডিসেম্বর সকালবেলা নৌকায় করে রূপসা নদী পার হয়ে খুলনা ঘাটে নামা মাত্রই রাজাকার জয়নাল পাকসেনাদের ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দেন আওয়ামী লীগ নেতা মোক্তার হোসেনকে। মোক্তার হোসেনের সঙ্গে আরো যারা ছিলেন তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে মোক্তার হোসেনের দু’ হাত এবং চোখ বেঁধে পাকসেনারা তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যান। পরবর্তীতে, খবর পেয়ে রাজাকার ক্যাম্পে ও মুসলিম লীগ নেতাদের কাছে ধর্ণা দিয়েও তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি ।আত্মীয় স্বজন ও পরিচিতজনদের সকলের ধারণা খুলনার গল্লামারি বধ্যভূমিতে তাকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অজস্র লাশের সঙ্গে হয়তো তার লাশও মিশে গিয়েছে। লাশ আর শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। দু’দিন পরে গ্রামের বাড়িতে পরিবারের কাছে সংবাদ পৌঁছালে ১৭ই ডিসেম্বর পরিবারের লোকজন খুলনায় এসে অনেক চেষ্টা করেও মোক্তার হোসেনের কোন সন্ধান পায়নি। সরকারী চলমান কাজের বিল, ব্যাংকে অর্থ, লকারে গচ্ছিত গহনা সর্বস্ব হারিয়ে পরিবারটি খুবই অসহায় দিনাতিপাত করছিলো। তবে স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শহীদ পরিবারগুলোর ২০০০ টাকার অনুদান পেয়েছিলেন এই পরিবারটি। বীর শহীদের দুই কন্যা মাহফুজা খানম কচি ও মাকসুদা আক্তার রুনু এবং ছেলে মোঃ মফিদুল ইসলাম টুটুল। পিতা হারানো এই সন্তানদের কাছে বাবা মানে দেওয়ালে লাগানো একটি ছবি আর লাল-সবুজের এই বাংলাদেশে, এটাই তাদের অহংকার। শহীদ মোক্তার হোসেনের সন্তান মোঃ মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, “পিতা হত্যার শোক স্বাধীনতার বিনিময়ে পুষিয়ে নিয়েছি তারপরও এই ক্ষত ও প্রতিশোধের আগুন থেকেই যায়। কিন্তু আমার বাবার আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের জন্য সামাজিকভাবে তিনি যে কাজগুলো করতেন বা তার যে দায়বদ্ধতা ছিল সেটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পূরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন।শহীদ মোক্তার হোসেন সহ সকল মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারীদের বিচার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করেন। তারা যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হোক এটাই তাদের প্রত্যাশা।
মুক্তিযুদ্ধের বেসরকারি শহীদদের গেজেটে শহীদ মোক্তার হোসেন দাড়িয়ার নাম রয়েছে। গোপালগঞ্জ স্টেডিয়াম এর পাশে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোক্তার হোসেন দাড়িয়ার নাম উল্লেখ আছে। শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে , স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শহীদের গ্রামের বাড়িতে “বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোক্তার দাড়িয়া স্মৃতি জাদুঘর ” নির্মাণ কাজ চলছে।
১৩ ডিসেম্বর শহীদ মোক্তার হোসেনের ৫০ তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা রইল।