১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার,রাত ২:৪৫

শিরোনাম

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং: নদীরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে উপকূল বাসী

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২২

  • শেয়ার করুন

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে নদীরক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে উপকূল বাসী।
সিডর,আইলা, বুলবুল, আমফান ও ইয়াসের পর ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এর প্রভাবে লঘূচাপটি নিম্নচাপে পরিণত হয়ে সোমবার সকাল থেকে বৃষ্টি ও মাঝারি ধরনের দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় মানুষ আইলা ও আমফানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে আবারও ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং।

পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ, শ্যামনগর, আশাশুনি,মোংলা, শরণখোলার মানুষ সিত্রাংয়ের ভয়াবহ ছোবল থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য নিরাপদে অবস্থান নিতে শুরু করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। ইতিমধ্যে একাধিক স্থানের বাঁধে ভাঙন ও ফাটল দেখা দেওয়ায় মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বাঁধের ভাঙন এবং জলোচ্ছ্বাসে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খুলনা শহরসহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে রবিবার মধ্য রাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টি ও একই সাথে বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। যা রাতের জোয়ারের সময় প্রবল হতে পারে।

সুন্দরবন উপকূলের খুলনার কয়রা উপজেলার হরিণখোলা এলাকায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। স্থানীয় মাছের ঘেরের মালিক আনারুল ইসলাম জানান, তিনি বেড়িবাঁধে ফাটল দেখে কাছে গেলে তার সামনেই বাঁধের একটি অংশ ভেঙে নদীতে মিশে যায়। বেড়িবাঁধ রক্ষায় তারা চেষ্টা করছেন, তবে কতটুকু সফল হবেন তা বলা মুশকিল। একইভাবে গাতির ঘেরি এলাকার বাঁধেও ধস দেখা দিয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গতকাল রবিবার মধ্যরাত থেকেই সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি ও বাতাসের গতিবেগ বাড়তে থাকে। এখনো প্রায়ই বাতাসের প্রবল ঝাপটার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। সকালে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীর পানি এখন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ জানিয়েছেন, খুলনায় সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

ভাঙনের ঝুঁকিতে বাঁধ

খুলনা জেলার দক্ষিণে সুন্দরবনসংলগ্ন তিনটি উপজেলা পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ । দাকোপের অধিকাংশ এলাকায় নতুনভাবে বাঁধে সংস্কার হলেও কমপক্ষে ছয়টি পয়েন্টে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে,এখানকার কালাবগি এলাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাইকগাছা সোলাদানায় ব্যক্তি উদ্যোগে নতুনভাবে বাঁধে সংস্কার হলেও ভাঙ্গন সম্ভাবনা রয়েছে। কয়রা উপজেলায় নদী-বাঁধ সংস্কারের কাজ হয়নি বললেই চলে। সিত্রাংয়ের আঘাতে এসব বাঁধের একাধিক জায়গায় ভাঙন দেখা দিলে এলাকাটি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় সর্বস্ব হারানো দাকোপ ও কয়রার অনেকেই এখনো স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পাননি। এরই মাঝে সিত্রাংয়ের আস্ফালনে তাদের চোখে আঁধার নেমে এসেছে। কয়রার ১২ কিলোমিটার বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলায় পাউবোর ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২১ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে এসব বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারে।

অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো হচ্ছে মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া, লোকা, গোবিন্দপুর, মঠবাড়ী ও পবনা। কয়রা সদর ইউনিয়নের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধগুলো হচ্ছে মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, হরিণখোলা, ঘাটাখালী, ৪ নম্বর কয়রা ও ৫ নম্বর কয়রা বালক সরদারের বাড়িসংলগ্ন এলাকা। মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সাতানী, দক্ষিণ ভাগবা ও হড্ডা ফুলতলা। উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কাঠকাটা, কাটমারচর, হাজতখালী, হরিহরপুর ও গাতীরঘেরী। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ চরামুখা, গোলখালী, বীণাপাণি, জোড়শিং ও আংটিহারা।

পাউবো কয়রা জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ তালুকদার জানান, কয়রা উপজেলার হরিণখোলা ও গাতীরঘেরী এলাকায় ভাঙন সৃষ্টি হয়ে লোকালয়ে যাতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে না পারে সে কারণে স্থানীয় জনগণের সাথে পাউবো মিলিতভাবে কাজ করছে।

খুলনা শহর ছাড়া উপজেলাগুলোর বেশির ভাগ এলাকায় রবিবার মধ্যরাত থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই।

ভয় বাঁধ নিয়ে

খুলনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে সকল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মানুষকে সতর্ক করা ও আশ্রয়কেন্দ্রে আসার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রসহ স্বেচ্ছাসেবক ও মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

তবে দাকোপ ও কয়রার মানুষের ঝড়ের চেয়ে বড় ভয় বেড়িবাঁধ নিয়ে। বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিলে পরিস্থিতি হবে খুবই ভয়াবহ। দাকোপের কালাবগি গ্রামের বাসুদেব রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা খুবই আতঙ্কে আছি। বৃষ্টি ও বাতাসের গতি বাড়ছে। বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। যদি বাঁধ ভেঙে যায়, তাহলে আমরা নোনা জলে ডুবে যাব। নদীর পানি বাড়লেই বিভিন্ন অংশে ভাঙন তৈরি হতে পারে। সরকার এখানে নতুন করে বাঁধ দিয়েছে, কিন্তু তাতেই আবার একাধিক জায়গায় ফাটল-ভাঙন দেখা দিয়েছে।’

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে বেড়িবাঁধ সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, কিন্তু এখনো বাঁধ মেরামত বা সংস্কারের কাজ শুরু হয়নি। ফলে আমরা খুবই আতঙ্কে আছি।’

কয়রা সদর ইউনিয়নের ঘাটাখালী এলাকায় যে বেড়িবাঁধটি বর্তমানে কোনোমতে এলাকার মানুষকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা করছে, এটি পঞ্চম বাঁধ। এর আগেও চারটি বেড়িবাঁধ ধসে গেছে। প্রথমবার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আর কখনোই শক্ত করে বাঁধ তৈরি হয়নি। ফলে বারবার ভাঙছে। কয়রা সদরসহ পার্শ্ববর্তী দুই ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ এই বাঁধ ভাঙলে বিপদে পড়বে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি আমাদের বহুদিনের। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকেই এ দাবিতে আমরা সোচ্চার ছিলাম। কিন্তু বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে আমাদের সঙ্গে ছলনা করা হচ্ছে। আশ্বাসে আশ্বাসেই পার হয়েছে এক যুগ।’

শ্যামনগর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন (এসো) জানান, ২০০ কিলোমিটার পাউবোর বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, পাউবোর বেড়িবাঁধের অবস্থা ভালো না। ঘূর্ণিঝড়ে নদীতে জলোচ্ছ্বাস হলে গাবুরা, পম্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনীসহ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হতে পারে।’

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আকতার হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় আগম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উপকূলীয় মানুষদের নিরাপদে নেওয়ার জন্য ১০৩টি সাইক্লোন সেন্টার স্কুল, মাদ্রাসাসহ ২০০ টি আশ্রয়ন কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষদের আনার জন্য বিভিন্ন এনজিও ও সিপিপি ৫ হাজার সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এটি আরো ঘনীভূত এবং উত্তর ও উত্তর–পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে আগামীকাল ভোররাত থেকে সকাল নাগাদ খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘সিত্রাং ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে। আসলে আমাদের মধ্য উপকূলে অর্থাৎ পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলার দিকেই এটি অগ্রসর হচ্ছে।’

তবে দেশের উপকূলের সর্বত্রই সিত্রাংয়ের প্রভাব পড়বে বলে জানান আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের উপকূল আকারে খুব বড় নয়। তাই সর্বত্রই এর প্রভাব পড়তে পারে।’

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝোড়ো বাতাস বয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে ভারী (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটার) বর্ষণ হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রবর্তী অংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চাট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের কাছের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে আট ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং আরও উত্তর-পূর্বদিকে এগিয়ে আসছে। সোমবার সন্ধ্যা নাগাদ এটি দেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানতে পারে। এটি দেশের ১৩টি জেলায় মারাত্মকভাবে এবং দুটি জেলায় হালকাভাবে আঘাত হানতে পারে।

 

 

ভাল লাগলে শেয়ার করুন
  • শেয়ার করুন